Tuesday, June 16, 2015

Parts of Human Body মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ

তুমি শুধু তোমার মতো


এই পৃথিবীতে কোটি কোটি শিশু বাস করে। এদের মধ্যে কেউই দেখতে ঠিক ঠিক তোমার মতো নয়। তুমি দেখতে হুবহু আর কারও মতো নও। তোমার টিপসই, তোমার পায়ের ছাপ পৃথিভীর আর সকল শিশু থেকে আলাদা। তোমার গায়ের ঘ্রাণও আলাদা। যেহেতু তোমার শরীরের ঘ্রাণের সঙ্গে আর কারও মিল নেই, তুমি চিঠি লিখতে পার তোমার কুকুরকে। যখন বাড়ীর বাইরে থাক, তখন একটা টিস্যু দিয়ে হাত-মুখ মুছে তুমি যদি সেটা ভাঁজ করে খামে ভরে পাঠিয়ে দাও, তোমার কুকুর টিস্যুর ঘ্রাণ নিয়ে বলে দিতে পারবে ওটা তোমার পাঠানো টিস্যু। কারণ তোমার শরীরের ঘ্রাণের মতো ঘ্রাণ পৃথিবীর আর কারও নেই। তোমার চিন্তা, তোমার অনুভূতির ক্ষেত্রেও তুমি সম্পূর্ণ আলাদা। তুমি নিজের মতো করে চিন্তা কর, তোমার আনন্দ-বেদনাও তুমি প্রকাশ কর তোমার নিজের মতো করেই। সুতরাং ভেতরেও বাইরে তুমি বিশেষ ব্যক্তি। কারণ পৃথিবীতে তোমার মতো শুধু তুমি আছ, আর কেউ নেই। এই বইয়ে আছে তোমার সম্পর্কে আরও অনেক কিছু, তোমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত অনেক কথা।

তোমার মুখমন্ডল

আয়নায় তোমার মুখের দিকে তাকালে তুমি দেখতে পাবে চোখ, কান, নাক, মুখ ইত্যাদি নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
তাকাও তোমার চোখের দিকে। চোখের ওপরে আছে ভ্রু, চোখ গিরে আছে চোখের পাতা। ভ্রু আর চোখের পাতা তোমার চোখে ধুলাবালি ঢুকতে দেয় না।
এবারতোমার একটি চোখের দিকে ভাল করে তাকাও! দেখ চোখের মণির চারপাশের রঙিন গোল এলাকা। একে বলে কনীনিকা। এর রঙ হতে পারে কালো, নীল, বাদামী, সবুজ বা ধূসর। এর মাঝখানে আরও গাড় রঙের যে, ছোট্ট ফোটার মত যায়গা, ওটাই তোমার চোখের মণি। এটা হলে তোমার চোখের ভেতর আলো ঢোকার দরজা।
কানের কাজ হল, শব্দ ধরে ফেলা। কানের ভেতরে আছে ছোট সুড়ঙ্গ পথ। ওই পথে কান দিয়ে শব্দ যায় মাথায়, তোমার মস্তিষ্কে। ফলে তুমি শুনতে পাও।
তোমার নাকে আছে দুটি ছিদ্র পথ। একে বলে নাসারন্ধ্র। প্রশ্বাসের সঙ্গে যে বোতাস তুমি গ্রহণ কর এবং যে ঘ্রাণ তুমি নাও তাও মস্তিষ্কের ভেতরে যায় নাসারন্ধ্র দিয়েই।
তোমার মুখের পথও চলে গেছে শরীরের ভেতরে। মুখ দিয়ে তুমি খাও, পান কর এবং কাথা বল। কখনও কখনও নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কাজও কর। তোমার মুখের ভেতরে আছে দাঁত। সামনের দিকের দাঁতগুলো ধারালো। এগুলো দিয়ে তুমি খাদ্য কেটে টুকরা টুকরা কর। অন্য দাঁতগুলো দিয়ে তুমি চিবাও। যাতে খাদ্য নরম হয় এবং সহজে গিলতে পারো। যখন তুমি কথা বল, তখন তোমার জিহ্বা ও দাঁত এমনভাবে কাজ করে, যাতে তুমি শব্দের সঠিক উচ্ছারণ করতে পার।
তোমার জিহ্বা সব সময় ব্যস্ত। জিহ্বা তোমার কথা বলা ও শব্দ উচ্চারণে সাহায্য করে। তুমি যখন খাদ্য চিাবও, তখন জিহ্বা খাদ্যকে এদিক-ওদিক আনা-নেওয়া করে। কোন কিছু জিহ্বায় ছোয়ালেই তুমি তার স্বাদ বুঝতে পার।

ডানে বামে মিল নেই
দুটি চোখ, দুটি ভ্রু, দুটি কান, দুটি নাসারন্ধ্র। এভাবে তোমার মুখ দুভাবে বিভক্ত। কিন্তু দুভাগই কি অবিকল একই রকম? আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখ। তোমার ভ্রæ’র একটি কি অন্যটির চেয়ে কিছুটা সোজা? কানের দিকেও তাকাও। দুটি কান কি একই রকম? মাথার দুপাশে তাকিয়ে দেখ। নিশ্চয়ই এক রকম নয়। এবার তাকাও তোমার মুখের দিকে। ভাল করে দেখ, দুপাশ নিশ্চয়ই এক রকম নয়। চুল যত শক্ত করেই বাঁধো না কেন, দেখবে, মাথার দুপাশে চুলগুলো দুরকম। অন্যান্য দুই অঙ্গও কখনও একই রকম নয়। যেমন তোমার দুই হাত। মেপে দখ, একটি থেকে আর একটি সামান্য বড়। ডান হাতের আঙ্গুলগুলোর তুলনায় বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলো সরু বা মোটা।
তুমি যখন এক জোড়া নতুন জুতা পর, তখন কি খেয়াল করেছ, একটি জুতা একটু বেশি টাইট (আঁটসাঁট) মনে হয়। এতে ভাবনার কিছু নেই। ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলেও সে বলবে, এটাই স্বাভাবিক

তোমাকে যদি মাঝামাঝি দুটুকরা করা যেত, তাহলে দেখা যেত, ডান দিকের সঙ্গে বাঁ দিকের সম্পূর্ণ মিল নেই। আয়নায় মুখ দেখলে বুঝবে, মুখের ডান দিক ও বাঁ দিক হুবহু এক রকম নয়, কিছু না কিছু পার্থক্য আছে।

তোমার চুল
কালো, বাদামী, লালছে, সোনালী-চুল হতে পারে নানা রঙের। আর মানুষের মাথায় থাকে মোটামুটি এক লাখ চুল। তুমি যদি একটি চুল টেনে তুলে ফেল, সেখানে গজাবে আর একটি নতুন চুল। চুল বাড়ে। কেটে ফেললে আবারও বাড়ে। কিন্তু এই চুল আসে কোথা থেকে?
তোমার ত্বকের মধ্যে আছে সূ সূ ছিদ্র। একে বলে লোমকূপ। লোমকূপের গোড়ায় আছে ক্ষুদ্র শিরা উপশিরা। এই শিরা-উপশিরার সাহায্যে রক্ত যায় চুলের গোড়ায়। ওই রক্ত থেকে চুল নেয় খাদ্য ও অক্সিজেন। এর সাহায্যে চুল বড় হয়। লোমকূপের মুখে আছে ছোট্ট একটি তেলের ভান্ড। এই তেলে কারণেই চুল চিকচিক করে।
প্রত্যেক ক্ষুদ্র লোমকূপে আছে পেশী। তুমি যদি ভয় পাও, তা হলে তোমার মনে হবে, চুলের গোড়া খাড়া হয়ে গেছে। এর কারণ তোমার মাথার উপরকার চুলের গোড়া ও পেশী নড়েচড়ে উঠে বলেই এরকম মনে হয়।
কারও চুল সোজা, কারও কোঁকড়ানো, কারও কারও চুল খুব বেশি বড় হয় না। চোখের পাতার লোম ও ভ্রæর চুল কখনও খুব একটা বড় হয় না। তবে তোমার মাথার চুল বছরে-১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
তোমার ত্বক
তোমার ত্বকও তোমার শরীরের একটি অঙ্গ। যখন তোমার ঘাম হয়, তখন ত্বকের উপর লোমকূপের গোড়া দিয়ে দেহের কিছু বর্জ্য বেরিয়ে আসে। আর তোমার দেহের তাপ যে সব সময় একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকে, তাও থাকে ত্বকের কারণেই।
মানুষের শরীরের ত্বক শক্ত। কোন কোন স্থানের ত্বক আরও বেশি শক্ত। পায়ের তলার ত্বক সবচেয়ে বেশি শক্ত। ত্বকে যদি আঁচড় কাট, কিংবা ত্বক যদি কেটে যায় বা ফেটের যায়, তাহলে আবার গােিয়ও ওঠে। শরীরের কোন কোন অংশের ত্ব খুব পাতলা আবার কোন কোন অংশের বেশ পুরু। পায়ের পাতার ত্বকের কথা বাদ দিলে পিঠের ত্বক সবচেয়ে পুরু। আর চোখের পাতার ত্বক সবচেয়ে পাতলা।

তবে ত্বক যত পাতলাই হোক, তার আছে দুটি স্তর। বাইরের স্তরকে বলা হয় বর্হিত্বক, বেথরের স্তরকে বলা হয় অন্ত:ত্বক। ত্বকের মধ্যে আছে সূ² শিরা-উপশিরা। তার ভেতরে আছে রক্ত। আর আঠে স্নায়ু। ত্বকের মধ্যে আছে ছোট ছোট ছিদ্র। এগুলো লোমকূপ। যখন তোমার গরম লাগে, তখন এই লোমকুপের গোড়া দিয়ে ঘাম বেরিয়ে আসে। ঘাম যখন শুকিয়ে যায়, তখন তুমি ঠান্ডা অনুভব কর।
যখন তোমার ঠান্ডা লাগে, তখন লোমকূপের গোড়া সঙ্কুচিত হয়ে যায়। ঘাম আর বের হয় না। ঠান্ডায় যখণ তুমি কাঁপতে থাক, তখন তোমার শরীরের তাপ বাড়ে এবং সে তাপ পেশীতে ছড়িয়ে পড়ে। ঠান্ডা লালে তোমার ত্বকের লোম খাড়া হয়ে যায় এবং লোমকূপের গোড়া ফুলে ওঠে। কারণ এসময় তোমার ত্বকের গোড়া দিয়ে কিছুটা বাতাস ঢোকে। ওই বাতাস শরীরকে উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে।
নখ ও হাত-পায়ের আঙ্গুল
তুমি কি জান, তোমার হাত ও পায়ের আঙ্গুলে কেন নখ আছে? এগুে লা আছে তোমার হাত ও পায়ের আঙ্গুলের ডগা রক্ষা করার জন্য।
নখগুলো তৈরি শক্ত কেরাটি দিয়ে। শক্ত চামরা থেকে তৈরি হয় কোরাটিন। অন্যান্য প্রাণীর থাবা, খুর ও শিং কেরাটিনেরই তৈরি। নখ তৈরি হয় আঙ্গুলের ভেতর থেকে। যেখানে দিয়ে নখ বের হয়ে আসে সে জায়গাটা কিছুটা বিবর্ণ অর্ধচন্দ্রের মতো দেখতে। নখের বাইরের অংশকে বলে কিউটিকল। নখ সব সময় বড় হতে থাকে। কাদা বা বালি নিয়ে খেলতে গিয়ে দেখেছ, নখের আগায় কাদা-ময়লা আটকে যায়। পায়ের নখেও তাই হয়। ওই ময়লা যাতে ত্বকের ভেতরে ঢুকে যেতে না পারে, তার জন্য তুমি নিশ্চয়ই ক্লিপ দিয়ে ময়লা বের করে ফেলো।
তোমার শরীরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল হাত ও পা। কোন কিছু তোলার জন্য তুমি ব্যবহার কর তোমার বুড়ো আঙ্গুল বাদ দিয়ে অন্য যে-কোন দুটি আঙ্গুল দিয়ে একটা পেন্সিল ধরে তোলার চেষ্টা করে দেখ। বুঝবে বুড়ো আঙ্গুল ছাড়া কাজটা কত কঠিন। বুড়ো আঙ্গুল ও অন্যান্য আঙ্গুল দিয়ে তুমি জামার বোতাম খোলো, জুতার ফিতা বাঁধো, ধরতে পারে কাঁটা চামচ, ছুটি প্রভৃতি।
তোমার পায়ের আঙ্গুলও গুরুত্বপূর্ণ। পা দিয়ে তুমি স্পর্শ করতে পার, ধরতে পার এবং কোন কোন জিনিস তুলতেও পার। তবে হাতের মতো অত সহজে পার না। কোন কোন ক্ষেত্রে হাত যা পারে না, পা তা পারে। পা তোমার শরীরের ভর রাখে। যখন লাফাও, দৌড়াও বা নাচো, তখন পায়ের আঙ্গুল তোমার শরীরের ভারসাম্য লক্ষা করে।
ত্বক কেন তে রঙের
মানুষের গায়ের রঙ অনেক রকম। কারও ত্বক বাদামী, কারও কালৈা, শ্যামলা, লালচে, কারও সাদা। কারও কারও গায়েল রঙ সোনার মতো উজ্জ্বল।
মানুষের ত্বকের ইে রঙ নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহু বছর গবেষণা করেছেন। তারা বের করার চেষ্টা করেছেন, কেন পৃথিবীর এক এক অঞ্চলের মানুষের ত্বকের রঙ এক এক রকম হয়। তারা মনে করেন, এক এক এলাকার রৌদ্রের তাপ অনুযায়ী সে এলাকার মানুষের ত্বকের রঙে এই বৈচিত্র এসেছে। গাঢ় রঙের ত্বকে আছে মেলানিন। সূর্যের প্রখর তাপ থেকে ত্বককে রক্ষা করার জন্য শরীরেই ওই মেলানিন তৈরি হয়। এ কারণেই যারা প্রখর রোদের দেশে বাস করে তাদের চামড়ার রঙ হয় গাঢ়।
যেখানে সূর্যের তাপ দুর্বল, সেখানে গাঢ় রঙের ত্বকের প্রয়োজন হয় না। সেখানে বরং ফ্যাকাশে ত্বকই ভাল। কারণ ঐ এলাকার মানুষের ত্বকের ভিতর দিয়ে রোদের আলো প্রবেশ করে তৈরি হয় গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন-ডি।
কখনও কখনও মেলানিন ত্বকের ওপর ছোট ছোট তিলের মতো দাগ সৃষ্টি করে। যাদের ত্বকে এ ধরনের দাগ পড়ে, তারা যদি আরও রোদে থাকে, তা হলে ওই দাগ আরও বাড়বে।
সম্পূর্ণ তোমার নিজ
তুমি যদি জানালার কাচে তোমার হাত দিয়ে চাপ দাও, দেখবে একটি ছাপ পড়েছে। পৃথিবীর আর কারও হাতের এমন ছাপ পাওয়া যাবে না। তোমার পায়ের ছাপও পৃথিবীর আর কারও প ায়ের ছাপের মতো নয়।
তুমি যদি তোমার হাতের আঙ্গুলের ডগার দিকে ভাল করে তাকাও, দেখতে পাবে খুব সরু সরু দাগ। সে দাগ কোথাও বা কেঁচোর মতো, কোথাও গোলাকার। প্রত্যেক আঙ্গুলের ওই রেখা আলাদা আলাদা। তোমার দশ আঙ্গুলের ছাপ দশ রকম।
হতে পারে কোথাও কেউ আছে, যে দেখতে প্রায় তোমার মতোই, কিন্তু তোমার আঙ্গুলের ছাপ থেকে তার আঙ্গুলের ছাপ আলাদা হবেই।
কোষের সমাহার
গাছপালা বল, প্রাণী বল আর মানুষই বল-সব জীবই কোষের সমাহার। তোমার নিজের পুরো শরীরও কোষ দিয়েই তৈরি। তোমার শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুরোটাই কোষের তৈরি। তোমার দেহের প্রতিটি কোষ এক একটি তুমি। বিশ্বাস করা যায়? এই কোষ অতি ক্ষুদ্র নরম জেলীর মতো জিনিস। এটা এতই ক্ষুদ্র যে তুমি খালি চোখে দেখতেই পাবে না। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হবে।
প্রতি মিনিটে তোমার শরীর তিন লক্ষ কোটিরও বেশি কোষ তৈরি করছে। প্রতিটি কোষ দুবাগ হয়ে আবার নতুন কোষ তৈরি করছে। এভাবে চলে সারা জীবন।
শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরির জন্য কোষগুলো দলবদ্ধ হয়। কোন দল তৈরি করে তোমার হৃদপিন্ড, কোন দল তৈরি করে পেশী, কোন দল তৈরি করে তোমার হৃদপিন্ড, কোন দল তৈরি করে পেশী, কোন দল তৈরি করে হাড়।
হাড়
তোমার শরীরে বহু আকারের বহু ধরনের হাড় আছে। পায়ের হাড় লম্বা। পায়ের আঙ্গুলের হাড় ছোট। পাঁজরের হাড় (জরন নড়হব) গোলাকার। মাথার হাড় চ্যাপ্টা, মেরুদন্ডের হাড় গুটি সুতার রীরের মতো।
হাড় খুব শক্ত। তবে এর বাইরের দিকটা যত শক্ত, ভেতরের দিকটা তত শক্ত নয়। পায়ের হাড়ের মাঝখানে ফাঁকা, টিউবের মতো। শরীরের এরকম আরও হাড় আছে। ওই ফাঁপা জায়গায় আছে মজ্জা। মজ্জা তৈরি হয় অনেক কোষ ও চর্বি দিয়ে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিরা উপশিরা আর কোষ তোমার শরীরের জন্য তৈরি করে রক্তের নতুন নতুন কোষ। হাড়ও জমা করে রাখে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ। প্রয়োজন হলে এই খনিজ পদার্থ ব্যবহার করে তোমার  শরীর। প্রতিদিন তোমার শরীরে যে নতুন কোষ তৈরি হচ্ছে তা তোমার হাড়কেও বাড়ায়। ফলে হাড় লম্বা হয়। তুমিও লম্বা হও। তবে বয়স বেশি হলে হাড় আর লম্বা হয় না।
শরীরের কাঠামো
তোমার শরীরের ভেতরে আছে কঙ্কাল। শরীরের সবগুলো হাড় জায়গামতো জোড়া দিলে যে কাঠামো হয়, সেটাই কঙ্কাল। কঙ্কাল না থাকলে মানুষের শরীর হত উলের পুতুলের মতো। এই কঙ্কাল তোমার শরীরের গড়ন তৈরি করে।
তোমার দেহের ভেতর যে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আছে, তাদের রক্ষা করে এই হাড়। খুলির ওপর যেসব হাড় আছে, সেগুলো তোমার মস্তিষ্ককে রক্ষঅ করে। পাঁজরের হাড় তোমার হৃদপিন্ড ও ফুসফুসকে রক্ষা করে। দুটি হাড়ের মাঝখানে থাকে নরম হাড়। এদের বলে কোমলাস্থি বা কার্টিলেজ। তোমার হাড়গুলোর একটির সঙ্গে যাতে অপরটি ঘষা না লাগে, সে জন্যই মাঝখানে থাকে ওই কোমলাস্থি।
দুটো হাড় যেখানে যুক্ত হয়, সেই জায়গাটাকে বলে সন্ধি। কোন কোন সন্ধিতে নড়াচড়া হয় না। যেমন খুলির হাড়ের সন্ধি। কোন সন্ধি নড়াচড়া করে। যেমন পায়ের সন্ধি। যখন তুমি হাঁটো, তখন অনেক হাড়ই একসঙ্গে কাজ করে।
তোমার পেশী
তোমার সারা শরীর পেশীতে ভরপুর। তোমার শরীরে কমপক্ষে ৬০০ পেশী আছে। এগুলোর কোন কোনটা হাড়ের সঙ্গে লাগানো। এসব পেশী তোমাকে চলাফেরা করতে সাহায্য করে। হাড়ের সঙ্গে লাগানো শক্ত মোটা পেশী আছে, যাদের বলা হয় রগ। হাত মুঠো করে ধরলে দেখবে খাড়া শক্ত রগ বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে না এলেও তুমি ধরলে বুঝতে পারবে, রগ কত শক্ত। পায়ের গোড়ালি যেখানে ভাঁজ হয়, সেখানে হাত দিয়ে তুমি দেখতে পাবে মোটা শক্ত দৃঢ় পেশী। এই পেশী তোমার হাঁটুর সঙ্গে গোড়ালির সংযোগ স্থাপন করেছে।
পায়ের পেশী তোমাকে দৌঁড়াতে সাহায্য করে। হাতের পেশী তোমাকে কোন কিছু তুলতে বা বহন করতে সাহায্য করে। ঘাড়ের পেশী তোমাকে মাথা উঁচু করে রাখতে সাহায্য করে। মুখের পেশী তোমাকে হাসতে, কাঁদতে কিংবা মুখের নানা ভঙ্গী করতে সাহায্য করে।
পেশী তোমাকে নড়াচড়া ও চলাচল করতে সাহায্য করে। তবে আর এক ধরনের পেশী আছে যেগুলো তোমার শরীরকে সঠিকভাবে চলতে সাহায্য করে। এগুলো হাড়ের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। পেশী তোমার খাদ্য মুখ শেকে পাকস্থলিতে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়  পাকস্থলির পেশী খাদ্য টুকরা টুকরা করতেও-সাহায্য করে। বুকের পেশী তোমার ফুসফুসে বাতাস আসা-যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করে। আর তোমার হৃদপিন্ড গঠিত হয়েছে বিশেষ ধরনের শক্ত পেশী দিয়ে। এর ফলে হৃদপিন্ড এত দৃঢ়ভাবে কাজ করতে পারে।
তুমি যেভাবে নড়াচড়া কর
তুমি দৌড়াও, লাফ দাও, শরীর বাঁকাও কিংবা মোচড় দাও। এর সবই তুমি করতে পার, কারণ তোমার শরীরে আছে পেশী। যেসব পেশী তোমাকে এসব কাজে সাহায্য করে, সেগুে লা হাড়রে সঙ্গে লাগানো এবং ইলাস্টিকের মতো। এরা প্রয়োজনে লম্বা হয়ে যায়। আবার প্রয়োজন শেষে আগের আকারে ফিরে আসে।
শরীরের বড় মাংসপেশীগুলো আছে হাতে এবং পায়ে, এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে রগ। রগগুলো থাকে পেশীর শেষ প্রান্তে। এই রগই হাড়ের সঙ্গে পেশীগুলোকে আটকে রাখে।
পেশীগুলো দলবদ্ধভাবে কাজ করে। এর কোন কোনটা যখন শক্ত হয়ে আকারে ছোট হয়ে যায়, তখন অন্য পেশী হয়ে যায় লম্বা। তুমি যখন তোমার কনুই বা হাঁটু ভাঁজ করে আবার সোজা কর, তখন ঐ ঘটনা ঘটে। তোমার যদি মাংসপেশীই না থাকত, তাহলে তুমি হাঁটাচলা করতে পারতে না। এমনকি সোজা হয়ে দাঁড়াতোও পারতে না।
শ্বাস নাও
লম্বা করে শ্বাস টানো তো। যে বাতাস ভেতরে টেনে নিচ্ছ, তুমি তার শব্দ শুনতে পারেব। যখন তুমি শ্বাস নাও, বাতাস ঢুকে যায় তোমার নাকের ভেতরে। তোমার নাকের মধ্যে আছে ছোট ছোট লোম। ওরা বাতাসের ধূলাবালি আটকে রাখে। তোমার নাকের ভেতরটা আবার ভেজা ভেজা। ওই ভেজা অংশ আটকে রাখে বাতাসের বেশির ভাগ জীবাণু।
শ্বাসের সঙ্গে যে বাতাস তুমি টেনে নাও, তার মধ্যে আছে অক্সিজেন নামের বিশেষ গ্যাস। বেঁচে থাকার জন্য তোমার  শরীরে এই অক্সিজেন দরকার। অক্সিজেনসহ উষ্ণ ও পরিস্কার বাতাস শ্বাসনালীর ভেতর দিয়ে ঢুকে যায় ফুসফুসে।
তোমার দুটি ফুসফুস আছে বুকের ভেতরে। তার ওপর আছে পাঁজরের হাড়ের খাঁচা। এই খাঁচা ফুসফুস দুটিকে রক্ষা করে। তোমার ফুসফুসের নিচে আছে পর্দার মতো শক্ত মাংসপেশী। একে বলে মধ্যচ্ছদা। এই মধ্যচ্ছদা ও মাংসপেশী পাঁজরের হাড়ের সঙ্গে আটকে থাকে। আর এই সুরক্ষার মধ্যে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে তোমার বুক ওঠানামা করে। তোমার বুক যখন ফুলে ওঠে, তখন বাতাস ঢোকে বুকের ভেতরে ফুসফুসের মধ্যে। তোমার বুক যখন নেমে যায়, তখন ফুসফুসের বাতাস বের হয়ে যায়। ফুসফুস থেকে যে বাতাস বের হয়ে আসে, তার সঙ্গে থাকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস। তোমার শরীরে এই গ্যাসের কোনো প্রয়োজন নেই।
রক্ত সঞ্চালন
ধুপ ধুপ ধুপ। বুকে হাত দিয়ে চাপ দিলে তুমি এরকম স্পন্দন অনুভব করবে। যেখান থেকে এই শব্দ হচ্ছে, সেটাই তোমার হৃদপিন্ড। হৃদপিন্ড আকারে তোমার হাতের মুঠোর সমান। এটি একটি পাম্পের মতো কাজ করে। এর প্রধান কাজ হল, তোমার সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা।
হৃদপিন্ডে আছে দুটি প্রধান অংশ। বাঁ দিকের অংশ এক ধরনের টিউবের সাহায্যে হৃদপিন্ড থেকে বিশুদ্ধ রক্ত সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়। ওই টিউব গুলো হল ধমনী। ধমনীর বিশুদ্ধ রক্ত তোমার শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। রক্ত একই সঙ্গে কোষগুলো থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বহন করে নিয়ে আসে। কার্বন ডাই অক্সাইড কোষের কাজে লাগে না। এই ব্যবহৃত রক্ত আবার ভিন্ন টিউব দিয়ে তোমার হৃদপিন্ডে ফিরে আসে, এই টিউব গুলোকে বলা হয় শিরা ।
ব্যবহৃত রক্ত এবার শিরা দিয়ে চলে আসে হৃদপিন্ডের ডান পাশে। এখান থেকে রক্ত চলে যায় ফুসফুসে। রক্ত সেখান থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিয়ে নেয় অক্সিজেন। ফলে রক্ত আবার বিশুদ্ধ হয়। এই বিশুদ্ধ রক্ত তখন চলে যায় হৃদপিন্ডের বাম অংশে। সকল কোষে অক্সিজেন পৌছে দিতে সেখান থেকে রক্ত আবার চলে যায় প্রতিটি কোষের কাছে। তোমার হৃদপিন্ড প্রতিদিন সাড়ে ছয় হাজার লিটার রক্ত সঞ্চালন করে।
রক্ত দ্রুত চলাচল করে। যে রক্ত এক্ষুনি তোমার হৃদপিন্ড থেকে বের হল সেটুকু পায়ের আঙ্গুলের শেষ কোষ পর্যন্ত অক্সিজেন পৌঁছে দিয়ে মাত্র এক মিনিটের মধ্যে ফিরে আসে হৃদপিন্ডে।
তোমার হৃদপিন্ড কত দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে, ডাক্তাররা তা বুঝতে পারেন তোমার পালস বা নাড়ী ধরেই। হৃদপিন্ডে একবার শব্দ হওয়ার অর্থ কিছুটা রক্ত ধমনী দিয়ে বের হয়ে যাওয়া।
তোমার কব্জির যেখানে ধমনী আছে, ঠিক তার ওপরে একটি বোর্ডপিন রাখলে দেখবে, সেটা তোমার হৃদস্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া করবে।
তোমার রক্ত
রক্ত তোমার শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন বহন করে নিয়ে যায়। তোমার শরীরের কোষগুলো বেঁচে থাকার জন্য এই অক্সিজেন দরকার। হাড়ের কোষ, পেশির কোষ, মস্তিষ্কের কোষ-সবার অবশ্যই চাই অক্সিজেন। প্রতিটি কোষ আবার তার অপ্রয়োজনীয় জিনিস বের করে দেয়। এটা বর্জ্য, শরীরে প্রয়োজন নেই। শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়া এবং কোষগুলো থেকে বর্জ্য বের করে আনার জন্যই দেহে আছে হাজার হাজার ধমনী ও শিরা। রক্ত প্রতিটি কোষ থেকে বর্জ্য বয়ে নিয়ে আসে। রক্ত থেকেও আবার সরিয়ে ফেলতে হবে বর্জ্য পদার্থ। সেই কাজটি করেদেয় তোমার বৃক্ক বা কিডনি। হৃদপিন্ড থেকে বিশুদ্ধ রক্ত সারা শরীরে চলে যায় সরাসরি। কিন্তু ফিরে আসে কিডনির ভিতর দিয়ে। এসময় কিডনি রক্তের বর্জ্য ছেঁকে রেখে দেয়। কিডনি থাকে তোমার পাকস্থলীর পেছনে মেরুদন্ডের সঙ্গে।
মানুষের শরীরে থাকে দু থেকে চার লিটার রক্ত। কেটে গিয়ে তোমার শরীর থেকে যদি কিছু রক্ত বের হয়ে যায়, তবে শরীর নিজেই সেই রক্ত তৈরি করে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়।
তোমার হাড়ের মধ্যে যে মজ্জা আছে, তা থেকে তৈরি হয় রক্ত কণিকা। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন রক্ত কণিকা তৈরি হচ্ছে। হাড়ের মজ্জা প্রতি মিনিটে কমপক্ষে ১০ কোটি রক্ত কণিকা তৈরি করে।
রক্তে আছে লোহিত কণিকা এদের কর্মী বলতে পার। এরাই দেহের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ফেরত নিয়ে আসে। রক্তের মধ্যে শ্বেত কণিকাও আছে। এরা যোদ্ধা। এরা শরীরের ভেতরে অনুপ্রবেশকারী রোগ জীবাণু ধ্বংস করে তোমাকে সুস্থ ও সবল রাখতে সাহায্য করে।
তোমার শীরের রক্ত নালীগুলোতে আছে বালব। রক্ত যাতে শুধু একদিকে চলাচল করে। রক্তের একদিকে চলাচল নিশ্চিত করার জন্যই এই বালব। তোমার পায়ের শিরার কথাই ধরা যাক। একবার হৃদস্পন্দন হলে খানিকটা রক্ত ওই শিরা দিয়ে ওপরে ওঠে। তখন রক্তের চাপে বালবের মুখ খুলে যায়। আর একবার হৃদস্পন্দনের আগ পর্যন্ত ওই বালবটি বন্ধ থাকে
শরীর নিজেই মেরামতকারী
তোমার শরীরের নিজেরই আছে মেরামত করার ক্ষমতা। কাটা-ফাটা সে নিজেই ভরিয়ে তোলে। যখন তুমি কোথাও ব্যথা পাও, তখন তোমার শরীর স্বাভাবিক কাজের বাইরে বিশেষ দায়িত্ব গ্রহণ করে।
ধরা যাক, এক টুকরা কাচে তোমার হাত কেটে গেছে। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখবে, যে রক্ত বেরিয়ে আসছে, তা ঘন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, তোমার শরীরের কোষগুলি একত্রিত হয়ে তোমার কাটা জায়গাটা ঢেকে ফেলে এবং রক্ত বের হতে বাধা দেয়। যে রক্ত বের হয়ে এসেছিল এক পর্যায়ে সে রক্ত শক্ত হয়ে যায়। এটা আসলে এক ধরনের ঢাকনা। শুকিয়ে গেলে একে চলটা বলা হয়।

এই চলটার নিচে কিন্তু কোষেরা কাজ চালিয়েই যায়। যে জীবাণু ঢুকে ছিল কেটে যাওয়ার সময়, রক্তের শ্বেত কণিকা সেগুলোকে খেয়ে ফেলে। তোমার ত্বকে কোষ জন্মে একটা থেকে দুটা হতে থাকে। চামড়া কেটে যাওয়ায় যেসব কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, তাদের জায়গায় নতুন কোষ জন্ম নেয়।

শরীরের আছে বিশেষ ধরনের মেরামতকারী কোষ। তারাও তাদের কাজ শুরু করে। প্রথমে তারা একটি জালের মতো কোষগুচ্ছ তৈরী করে। এই কোষের জাল দিয়ে আটকে দেয় কাটা অংশের দুপ্রান্ত। লক্ষ করবে, প্রতিদিন ওই জালের এলাকা আরও পুরু ও শক্ত হচ্ছে। ওটাই চলটা। কয়েক দিন পর দেখবে, চলটা উঠে গেছে। কিন্তু একটা দাগ থেকে যাবে বেশ কিছু দিনের জন্য।

তোমার হাতে কি কখনও আগুনের তাপ লেগে ফোস্কা পড়েছিল? ওই ফোস্কা আসলে তোমার ত্বকের স্তরের নিচে ছোট্ট পকেট। ত্বকের ওপরের স্তরে থাকে জীবাণু। সে জীবাণু যাতে তোমার শরীরের ভেতরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য ওই ফাঁকা তৈরী হয় এবং ফাকা জায়গা ভরে যায় তরল পদার্থে। এরপর কোষেরা ত্বকের নিচের স্তর মেরামত করতে শুরু করে। ফোস্কার পানি আবার ধীরে ধীরে শরীরের ভেতরে ঢুকে যায় এবং ফোস্কা সেরে যায়।
পালাও অথবা লড়াই করো
ধরা যাক, গেছ কোন বন্ধুর বাসায়। সেখানে গিয়ে ফাঁকা জায়গা পেয়ে নেমেছ ফুটবল খেলতে। এমন জোরে মেরেছ যে, বল পাশের বাসার দোতলার জানালার কাচ ভেঙে ঢুকে গেল ঘরের ভেতরে। কিছুক্ষণ পর একটা ভারী মুখের মাঝবয়সী লোক বেরিয়ে এসে চীতকার করে বলল, “এ বল কার?” এই অবস্থায় তোমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাবে। তুমি শ্বাস নেবে দ্রুত। তোমার চেহারা হয়ে যাবে ফ্যাকাশে। তুমি পালাতে চাইবে।

তুমি কি কখনও এমন অবস্থায় পড়েছ? এরকম অবস্থায় খবর দ্রুত চলে যায় তোমার কিডনির ঠিক উপরে অবস্থিত দুটি জায়গায়। তোমার শরীরের ওই দুটি প্রত্যঙ্গ তৈরি করে এক ধরনের রসায়ন। একে বলে অ্যাড্রেনালীন। অ্যাড্রেনালীন দ্রুত মিশে যায় রক্তে। তখন তোমার রক্তের সঞ্চালন বাড়ে। এতে অ্যাড্রেনালীন সারা শরীরের রক্তে মিশে যায়। তোমার শরীর এখন জরুরী অবস্থা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত। তোমার পাকস্থলি কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। তোমার পেশীগুলো সজাগ হয়ে গেছে। এর সব কিছুর লক্ষ্য বিপদ থেকে দূরে সরে যাওয়া। রক্তে অ্যাড্রেনালীন চলাচল করলে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তাকে বলে পালাও বা লড়াই করো

অ্যাড্রেনালীন এক ধরনের হরমোন। এগুলো তৈরি হয় তোমার শরীরের বিভিন্ন লালাগ্রন্থি থেকে। এক এক লালগ্রন্থির হরমোন এক এক ধরনের কাজ করে। তোমার বৃদ্ধি, শরীরের সকল জায়গায় অক্সিজেন ও খাদ্য পৌঁছে দেয়া, রক্তের ক্যালসিয়াম নিয়ন্ত্রন করা, এবং শরীরের শর্করা নিয়ন্ত্রন করা-এগুলো সব হরমোনের কাজ।
কিডনির কাজ
পিঠের দিকে পাঁজরের হাড়ের ভেতরে মেরুদন্ডের দুপাশে আছে তোমার দুটি কিডনি বা বৃক্ক। এরা দেখতে শিমের বিচির মতো এবং আকারে তোমার হৃপিন্ডের অর্ধেক।
কিডনি শরীরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করে, আর তা হল এটা তোমার রক্ত পরিস্কার রাখে। প্রতিদিন কিডনি দিয়ে ১৭০ লিটার রক্ত সঞ্চালিত হয়।
রক্ত যখন সারা শরীরের কোষগুলো থেকে হৃদপিন্ডে ফেরত  আসে, তখন নিয়ে আসে বর্জ্য। যা শরীরের কোন কাজে লাগেনা। রক্ত ফেরত আসে কিডনির ভেতর দিয়ে। তখন কিডনি ওই বর্জ্যগুলোকে রক্ত থেকে ছেঁকে রেখে দেয়।
কিডনিও বর্জ্য ঝেড়ে ফেলে দিতে চায়। তাই প্রশ্রাব তৈরি করে এবং প্রশ্রাবের মধ্য দিয়ে ঐ বর্জ্য বের করে দেয়। প্রশ্রাব দুটি টিউব দিয়ে বেরিয়ে আসে। ওই দুটি টিউবকে বলে মুত্রনালী। প্রশ্রাব মুত্রনালী দিয়ে এসে জমকা হয় মুত্রথলিতে।
এই মুত্রথলি নরম পাতলা পেশী দিয়ে গঠিত। যখন এই থলি ভরে যায়। তখনই তোমার প্রশ্রাবের বেগ চাপে। যখন তুমি প্রশ্রাব কর, তখন মুত্রথলি সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং প্রশ্রাব বের হয়ে আসতে থাকে। প্রশ্রাব বের হয়ে আসে মুত্রপথ দিয়ে।
খাবার সময় কী ঘটে?
মচ করে খাচ্ছ কোন প্রিয় খাবার। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছ, কোথায় যায় এসব খাদ্য? আর তোমার শরীরের ভেতরে খাবারগুলোর কী অবস্থা হয়?
খাবার প্রথমে যায় তোমার মুখের ভেতরে। এগুলোকে তুমি চিবিয়ে টুকরা টুকরা করো, যাতে গিলতে সুবিধা হয়। টুকরা টুকরা করার কাজটি করে তোমার দাঁত। মুখের ভেতরে আছে লালাগ্রন্থি। এই লালাগ্রন্থি থেকে যে রস বের হয় তাকে বলা হয় লালা বা থুতু। এই লালা খাদ্যের সঙ্গে মিশে খাদ্যকে নরম করে, যাতে গিলতে সুবিধা হয়। ভেতরে নাড়াচাড়া করা ও খাদ্যকে পেটের ভেতরে পাঠানোর কাজটি করে তোমার জিহ্বা। গিলে ফেলা মাত্র অন্ননালী দিয়ে খাবার যেতে থাকে তোমার জিহ্বা। গিলে ফেলা মাত্র অন্ননালী দিয়ে খাবার যেতে থাকে তোমার শরীরের ভেতরে। তুমি আট পর্যন্ত গুনতে গুনতে খাদ্য চলে যাবে  পাকস্থলিতে। এখন এটা অন্যরূপ নেবে, যাতে এই খাদ্যের নির্যাস তোমার শরীর গ্রহণ করতে পারে।
তোমার দাঁত যে কাজ শুর করেছিল, একই কাজ করতে শুরু করবে তোমার পাকস্থলি। পাকস্থলি খাদ্যকে ভাঙবে, চটকাবে এর ওপর দেবে আরও কিছু রস। খাদ্য যখন তোমার পাকস্থলি থেকে ক্ষুদ্রান্ত্র হয়ে বৃহদান্ত্রে যাবে, তখন ওটা হবে একেবারে টুথ পেস্টের মতো নরম ও আঠালো।
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্র
খাদ্য তোমার পাকস্থলিতে থাকে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা। তারপর খাদ্য নেমে যায় ক্ষুদ্রান্ত্রে। ক্ষদ্রান্ত্রে আছে শক্তিশালী রাসায়নিক, একে বলে এনজাইম। আর থাকে পাচক রস। ক্ষুদ্রান্ত্রের গা থেকে এসব রস বের হয়ে খাদ্যের সঙ্গে মিশে যায়। এনজাইমের নজর বড় তীক্ষ্মকোন খাদ্য কণা যদি এনজাইমের সংস্পর্শে না আসে, তবে এনজাইম তাকে খুঁজে বের করে ক্ষুদ্রান্ত্রের ভেতর গিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত গলিয়ে ফেলে। ক্ষুদ্রান্ত্রে খাদ্য ৪০ ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। তবে ওই অবস্থায় সেটা আর ভাত-মাছা থাকে না। খাদ্য তখন হজম হয়ে গেছে। ওই খাদ্যের নির্যাস তখন অতি ক্ষুদ্র অণুতে পরিণত হয়। এগুলো এতই ক্ষুদ্র যে, এরা ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়াল ভেদ করে বের হয়ে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। রক্ত তখন ওই অণুগুলোকে নিয়ে যায় কোষের কাছে। ফলে তোমার কোষ সতেজ থাকে। তুমি বড় হও এবং সুস্থ থাক।

তোমার শরীর যে খাদ্য ব্যবহার করতে পারে না, সেটা ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে বৃহদান্ত্রে যায়। বৃহদান্ত্রের শেষ মাথায় আছে পায়ুপথ। ওই পথ দিয়ে খাদ্যের বর্জ্য মল আকারে বের হয়ে আসে।

খাদ্য হল জ্বালানি
খাদ্য তোমাকে শক্তি জোগায়। তোমাকে বড় হতে ও সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। আমিষ, স্নেহ ও শর্করা জাতীয় খাদ্য আমরা খাই। আমিষ জাতীয় খাদ্য শরীরের বৃদ্ধি ঘটায়, পেশী, ত্বক ও অন্যান্য অঙ্গ গঠনে এবং রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। শরীরে যদি আঘাত লাগে, কেটে যায় বা ভেঙ্গে যায়, তবে তা মেরামত করতেও আমিষ জাতীয় খাবার সাহায্য করে।
¯œহ ও শর্করা জাতীয় খাবার তোমার জন্য শক্তির জোগান দেয় এবং তোমার শরীর উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে। খাদ্যের মধ্যে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও পানি থাকে। আর থাকে শক্ত জিনিস, যেমন গোল আলুর খোসা, প্রভৃতি। এগুলোকে ভূষিও বলা যায়। খাদ্যে থাকে ক্যালসিয়াম ও লোহার মতো খনিজ, থাকে এ,বি,সি ও ডি ভিটামিন। এরা তোমার স্বাস্থ্য ভাল রাখে। পানিও খুব দরকারী। কারণ পানি তোমার রক্ত তৈরিতে এবং সারা শরীরে খাদ্য-নির্যাস পৌঁছাতে সাহায্য করে। তোমার কিছু ভূষি জাতীয় খাবারও দরকার। এগুলো অন্ননালী থেকে খাদ্যকে পাকস্থলিতে যেতে সাহায্য করে।
সে জন্য দরকার সুষম খাদ্য। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ভাত-রুটি, মাখন, ঘি, চিনি, আলু, টমেটো, শাকসবজি পরিমিত খেলে তা শরীর গঠনে সঠিকভাবে কাজে লাগে।
মস্তিষ্কের কাজ
মগজ বা মস্তষ্ক দেখতে বিরাট আকারের একটি আখরোটের মতো। তোমার খুলির ভেতরে পুরোটা জুড়েই থাকে মস্তিষ্ক। ভ্রæর পেছনে হাড়ের নিচ থেকেই মস্তিষ্ক শুরু, মাথার পেছনে শেষ। মাথায় হাত দিলে পাবে শক্ত হাড়। একে বলে খুলি। এটাও আখরোটের খোসার মতো। আর এই কঠিন খুলির নিচেই আছে নরম মগজ। মগজ নিরাপদে রাখার জন্যই তার উপর আছে কঠিন খুলি।
তোমার মস্তিষ্ক বেশ বড় এবং ভারী। ছয় বছর বয়স হলেই মস্তিষ্কের বৃদ্ধি সম্পূর্ণ হয়। তখন এর ওজন হয় ১.৪ কিলোগ্রাম। মস্তিষ্ক গঠিত কোটি কোটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দিয়ে। এসব কোষ তোমার চিন্তাভাবনা, অনুভূতি, স্মরণশক্তি এবং শরীরের নড়াচড়া চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের কোষগুলি কখনও বিশ্রাম নেয় না, সব সময় কাজ করে। এমনকি তুমি যখন ঘুমিয়ে থাক, মস্তিষ্ক তখনও তার কাজে ব্যস্ত থাকে।

তোমার শীরের অন্যান্য কোষ থেকে মস্তিষ্কের কোষ ভিন্ন রকম। শরীরের অন্য কোষে যদি কোন আঘাত লাগে, তবে সে ক্ষত তারা নিজেরাই মেরামত করে ফেলতে পারে। কিন্তু মস্তিষ্কের কোষ তা পারে না। ওই কোষ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেটার বদলে মস্তিষ্কে নতুন কোষ জন্ম নেয় না। তুমি যখন জন্ম গ্রহণ কর, তখনই তোমার মস্তিষ্কে প্রায় সকল কোষ থাকে। যখন তুমি কুব বুড়ো হয়ে যাবে, তখন অনেক বিষয় স্মরণ করতে তোমার কষ্ট হবে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ এ সময়ের মধ্যে তোমার মস্তিষ্কের অনে কােষ নষ্ট হয়ে যাবে। যা আর নতুন করে তৈরি হবে না। মস্তিষ্ক সচল থাকার  জন্য এর কোষগুলোর দরকার খাদ্য ও অক্সিজেন। খাদ্য ও অক্সিজেন আছে তোমার রক্তে। আর তোমার হৃদপিন্ড তো প্রতি মুহূর্তে রক্ত পাম্প করেই যাচ্ছে। মস্তিষ্কের কোষে গিয়ে সে রক্ত পৌঁছায় ছোট ছোট নালীর মাধ্যমে এদের বলে কৌশিক নালী। এই কৌশিক নালী সারা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে আছে।
স্মৃতির ভান্ডার
মস্তিষ্কের আছে নানা অংশ। এক এক অংশের এক এক কাজ। এর একটি অংশ চিন্তার। সাধারণত একে আমরা বলি মন। এই মন যে কত কিছু নিয়ে কাজ করে, তার ইয়ত্তা নেই। মনের কাজই মানুষকে মানুষ করে তোলে। তোমার চিন্তা, অনুভূতি, সিদ্ধান্ত, ধারণা সবই নিয়ন্ত্রণ করে মন।
মস্তিষ্ক তোমার স্মৃতি ও জ্ঞানের ভান্ডার। তুমি যা কিছু শিখেছ, তার সবই মস্তিষ্কে জমা থাকে। যখন স্মরণ করতে চাও, তখন তা মনে আসে। এমনকি তুমি হয়ত ভেবেছ, ভুলে গেছে কোন একটি জিনিস। কিন্তু কয়েক বছর পর বিষয়টি হঠাত তোমার মনে পড়ে যেতে পারে। হুবহু যেভাবে ঘটেছিল ঠিক ঠিক সেভাবে।

ধরা যাক, স্কুলে তুমি শিখেছ দুই দুগুনে চার কিংবা শিখেছ গোলাপ-এর বানান। এরা তোমার স্মৃতিতে জমা হবে। পুনরায় ব্যবহারের জন্য তোমার মস্তিষ্কে যা কিচু জমা তাকে, তার সামান্য অংশ এই অঙ্ক কিংবা বানান। তোমার জীবনের অনেক ঘটনাও ওখানে জমা হয়। হয়ত গিয়েছিলে বন্ধুর জন্মদিনে, কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেন বা চিড়িয়াখানায়, একদিন ভয় পেয়েছিলে, বৃষ্টিতে ভিজেছিলে, এসব ঘটনাও ঠিক জমা হয়ে যায় মস্তিষ্কে। তোমার খেয়ালই নেই। হঠাত একদিন হুবহু মনে পড়বে ওই ঘটনা।

জীবনের এই ঘটনাগুলি তোমার ভবিষ্যতের জন্য কুব গুরুত্বপূর্ণ। যখন তুমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে যাবে, তখন ওই ঘটনাগুলো তোমাকে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে তোমার মনে পড়বে অতীতের অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি আর বর্তমান অবস্থার কথা। ফলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে। তোমার স্মৃতির কারণেই তোমার মন অন্য সকলের থেকে আলাদা। তোমার স্মৃতি শুধু তোমারই। অন্য কারও সঙ্গে তার মিল নেই।
স্মৃতির খেলা
তোমার স্মৃতিশক্তি কতটা প্রখর তার পরীক্ষা করতে পার নিজেরাই। এটা একটা খেলা। খেলতে লাগবে কমপক্ষে দুজন।
খেলাটি খেলতে আরও লাগবে:
কাগজ-কলম, একটি ঘড়ি একটি ট্রে ও ১৫টি বিভিন্ন ধরনের চেনা জিনিস। একজন হবে পরীক্ষক। অন্যরা হবে এই খেলায় অংশগ্রহণকারী। পরীক্ষক বসে রুমের ভেতরে। অন্যরাযাবে বাইরে। তখন ট্রের ওপর সাজাতে হবে ঐ ১৫টি জিনিস। সবই প্রতিদিন ব্যবহারের জিনিস। পেন্সিল, রাবার, কাপ, ক্যামেরা, পয়সা, বাঁশি প্রভৃতি। এগুলো ট্রের ওপর সাজানো শেষ হলে ডাক দাও খেলায় অংশগ্রহণকারীদের। ট্রেটা দেখতে তাদের সময় দেবে ঘড়ি ধরে মাত্র দশ সেকেন্ড। তারপর সরিয়ে ফেল ট্রেটা ওদের চোখের সামনে থেক্ েএবার খেলোয়াড়দের বরো ট্রে তে কি কি জিনিস ছিল কাগজে লিখতে। কেউ কি সবগুলো জিনিসের নাম লিখতে পেরেছে? প্রতিদিনের জিনিস, তবু মনে রাখা কি এতই সহজ?

নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র
আহবলে চীতকার করে উঠলে। ব্যথা পেয়েছ কনুইয়ে। ব্যথা যে তুমি পেয়েছ সে কথা জানলে কি করে? বলে দিয়েছে তোমার মস্তিষ্ক। তার ফলেই তুমি জানতে পেরেছ ব্যথাটা কোথায়, কতটুকু। মস্তিষ্ক কীভাবে জানায়?
মস্তিষ্কেই তোমার শরীরের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। মস্তিষ্ক শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে বার্তা গ্রহণ করে এবং তার জবাবে বার্তা ফেরত পাঠায়। এই বার্তা যায় খুব দ্রুত। এক সেকেন্ডে মস্তিষ্ক থেকে তোমার পায়ের বুড়ো আঙ্গুল পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ বার বার্তা যাতায়াত করতে পারে।
এই বার্তা যাতায়াত করে অত্যন্ত সূ² সুতার মতো জিনিসের সাহায্যে। এগুলোকে বলে স্নায়ু। শরীরের মধ্যে আছে হাজার হাজার স্নায়ুতন্তু। এগুলো যেন অতি সূ² টেলিফোনের তারের মতো মুহূর্তে তোমার মস্তিষ্কের সঙ্গে কথাবার্তা আদান-প্রদান করে ফেলে। বেশির ভাগ স্নায়ুই সংযুক্ত থাকে মেরুদন্ডের সঙ্গে। মেরুদন্ডের ভেতরে আছে মেরুরজ্জু। ওই মেরুরজ্জুর মাধ্যমেই বার্তা যায় মস্তিষ্কে।

শুধু আঘাত পেলেই যে মস্তিষ্কে বার্তা চলাচল করে, তা নয়। স্নায়ু ঠান্ডা বা গরমের অনুভূতির বার্তাও মস্তিষ্কে পাঠায়। এরা তোমার হৃদপিন্ড, ফুসফুস, পাকস্থলি, ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্র এবং অন্য সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকেও বার্তা নিয়ে যায় মস্তিষ্কে। মস্তিষ্ক এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সব সময় কাজে ব্যস্ত রাখে। তুমি চেষ্টা করেও হৃদপিন্ড বা ফুসফুসের কাজ বন্ধ রাখতে পারবে না। স্নায়ুরা তোমার চোখ-কান, নাম-মুখ থেকেও বার্তা নিয়ে মস্তিষ্কে জানায়। মস্তিষ্ক তখন সব খবর পৌঁছে দেয়।

এছাড়া নিজের অজান্তেও কিছু কিছু ঘটনা ঘটে। যেমন-কেউ যদি হঠাত করে তোমার চোখের দিকে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দেবার ভঙ্গি করে, তবে তোমার চোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। টক দেখলে অনেক সময় জিভে পানি আসে। এটা ঘটে, নিজের অজান্তেই। এজন্য আমরা মস্তিষ্কের ভান্ডারে আগে কিছু জমা করিনি। মানুষ এটা নিয়েই জন্মায় একে বলে রিফ্লেক্স অ্যাকশন বা নিজের অজান্তেই কিছু করা।
কথা বলার যন্ত্রপাতি
বুক ভরে শ্বাস নাও। এবার আহ্হ্হ্করে বাতাস বের করে দাও। দেখবে শব্দ হচ্ছে। ফুসফুসে যদি বাতাস থাকে, তবেই এরকম শব্দ করা সম্ভব। যখন বাতাস সব বেরিয়ে যাবে, তখন আর শব্দ করা সম্ভব হবে না। সুতরাং বুঝতে পারছ, কথা বলার জন্য তোমার ফুসফুস কত গুরুত্বপূর্ণ।

এবার ঘাড়টা পিঠের দিকে নামিয়ে দাও। গলার একেবারে নিচে তোমার আঙ্গুল রেখে পুনরায় আহ্হ্হ্শব্দ কর। তুমি বুঝতে পারবে, কিছু একটা নড়ছে। এটা তোমার বাগযন্ত্র। এটা পাশাপাশি প্রায় লাগানো দুটুকরা চামড়ার একটা বাক্স। এই চামড়ার পর্দা তোমার স্বরতন্ত্রী । এ দুটো ত্বকের মাঝখানের জায়গাটাকে বলে শ্বাসরন্ধ্র। যখন তুমি কথা বল বা গান গাও, তখন ফুসফুস থেকে বাতাস এসে তোমার শ্বাসরন্ধ্রে ধাক্কা দেয়। এতে স্বরতন্ত্রী কেঁপে ওঠে। এই কম্পনের ফলে একটা শব্দ তৈরি হয়। একটি বেলুন ফুলিয়ে যদি বাতাম ছেড়ে দাও, তবে কোন শব্দ হবে না। কিন্তু বেলুনের গলাটা দুপাশে টেনে ধরে যদি বাতাস বের হতে দাও, দেখবে তীক্ষ্ম শব্দ হচ্ছে। তোমার বাগযন্ত্রও এভাবে কাজ করে।

জন্মের পর বাইরের বাতাস তোমার ফুসফুসে ঢুকেছিল। ওই বাতাস বের হবার সময় তোমার স্বরতন্ত্রী কেঁপে উঠেছিল। তুমি কেঁদেছিলে। ওটাই তোমার প্রথম শব্দ।

আস্তে আস্তে বড় হয়েছে, আর নানা শব্দ করার জন্য তুমি তোমার জিভ, দাঁত, ঠোঁট ব্যবহার করতে শিখেছ। মা, বাবা, বলতে শিখেছ। অন্যদের কথা নকল করতে শিখেছ। এভাবে তুমি কথা বলা শিখে ফেলেছ।

এই পৃথিবীতে কারও কন্ঠস্বর অবিকল তোমার মতো নয়। তুমি কথা বলার সময় তোমার জিভ, দাঁত, ঠোঁট, তালু, নাক, গলা ব্যবহার কর। অন্য কারও এসব অঙ্গের সঙ্গে তোমারটার মিল নেই। ফলে তোমার স্বর হয় আলাদা। তুমি এই স্বর নিয়ন্ত্রণ করে অন্যকে নকল করতে পার। জোরে বা ধীরে কথা বলতে পার। আর শুধু মাত্র কণ্ঠস্বর শুনে প্রায় চেনা সকলেই তুমি চিনতে পার। এমনকি টেলিফোনে কথা শুনেই বলতে পপার, কে কথা বলছে।
পাঁচ ইন্দ্রিয়
তুমি দেখতে, শুনতে, স্পর্শ করতে এবং স্বাদ ও ঘ্রাণ নিতে পার। তোমার এই ক্ষমতার নামই ইন্দ্রিয়। মানুষের এই পাঁচটিই ইন্দ্রিয় থাকে। তুমি চোখ দিয়ে দেখ, কান দিয়ে শোনো। হাত ও পা দিয়ে স্পর্শ করতে পার। নাক দিয়ে নাও ঘ্রাণ আর জিভ দিয়ে নাও স্বাদ

তোমার এই ইন্দ্রিয়গুলি কিছু স্নায়ুর সঙ্গে লাগানো। এসব ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তুমি কোন কাজ করলে তোমার স্নায়ু মস্তিষ্কে খবর দেয়। তখন তুমি স্বাদ নিলে বুঝতে পারো স্বাদ মিষ্টি না তেতো, ঘ্রাণ নিলে বুঝতে পার গোলাপ না রজনীগন্ধ। কিছু স্পর্শ করলে বলতে পার গরম কি ঠান্ডা অথবা শক্ত কি নরম। কোন একটি পরিচিত শব্দ শুনলে বুঝতে পার এটি কার বা কিসের শব্দ। কিছু দেখলে বলতে পার কি দেখছ।
তোমার দৃষ্টি শক্তি
তুমি দেখতে পাও। তোমাকে কোন কিচু দেখানোর জন্য একসঙ্গে কাজ করে তোমার চোখ ও মস্তিষ্ক।

যখন তুমি কোন জিনিসের দিকে তাকাও, সেটার ওপর থেকে ঠিকরে আসা আলো পড়ে তোমার চোখে। সে আলো চোখের কর্ণিয়ার মধ্য দিয়ে চক্ষু গোলকের ভেতরে ঢোকে। কর্ণিয়া হল চোখের উপর স্বাচ্ছ আবরণ। ঐ আলো তোমার চোখের পেছনে যে স্নায়ু আছে, সেখানে পৌঁছে। স্নায়ু তখন ওই আলোর খবর পাঠায় মস্তিষ্কে। মস্তষ্ক যখন ঐ খবর পায়, তখন তুমি বুঝতে পার, তুমি কিছু দেখছ। চোখের ওপর রঙিন গোল এলাকাটাকে বলে কনীনিকা। এর মাঝখানে আরও গাঢ় ছোট্ট ফোটার মতো জিনিসটা হল তোমার চোখের মণি। আসলে এটা একটি ছিদ্র। এর ভেতর দিয়েই আলো ঢোকে তোমার চোখে।

চোখের কনীনিকায় কত স্নায়ু আছে, তার ওপর নির্ভর করে তোমার চোখের মণি ছোট হবে না বড় হবে, আলো বেশি ঢুকবে না কম ঢুকবে। অন্ধকারে চোখের মণি বড় হয়ে যায়। সূর্যের কড়া রোদে মণি ছোট হয়ে যায়। ইে মণির পেছনেই আছে লেন্স। এটা  স্বাচ্ছ। এর মধ্য দিয়েই আলো ভেতরে ঢোকে।

তোমার চোখের ভেতরটা জেলীর মতো স্বাচ্ছ তরল পদার্থে ভরা। আলো যায় এদের ভেতর দিয়েও। এই আলো গিয়ে তোমার চোখের পেছনের দেয়ালে লাগে। এই দেয়ালটাকে বেলে রেটিনা। রেটিনায় আছে এক লাখেরও বেশি সূক্ষ্ম স্নায়ূ।

এই সূ² স্নায়ু প্রথমে বার্তা পাঠায় বড় স্নায়ুর কাছে। সে স্নায়ু ঐ বার্তা নিয়ে যায় মস্তিষ্কে। মস্তিষ্ক ওই বার্তা বোঝে এবং তোমাকে বলে য়ে তুমি কী দেখছ।
তুমি যদি স্বাভাবিক দূরত্ব থেকে কোন জিনিস স্পষ্ট দেখতে না পাও, তা হলে তোমার সাহায্য দারকার।

সাধারণ চক্ষুগোলক আকারে গোল হয়। যাদের চক্ষুগোলক লম্বা হয়, তারা দূরের জিনিস ভাল দেখতে পায় না। চশমা পরলে এই অসুবিধা দূর হয়ে যায়।
আবার যাদের চক্ষু গোলক বেশি ছোট, তারা কাছের জিনিস স্পষ্ট দেখতে পায় না। এদের ক্ষেত্রেও চশমাই একমাত্র ব্যবস্থা। তবে আজকাল চশমার বদলে কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করা হয়। কন্টাক্ট লেন্স চোখের সঙ্গে সেঁটে লাগানো হয়।

আলো যদি চোখের ভেতরে গিয়ে রেটিনার ওপর একটি বিন্দুতে না পড়ে, তা হলেই দেখতে অসুবিধা হয়। চোখের অসুবিধা অনুযায়ী চশমা নিলে আলো ফেলা যায় এক বিন্দুতে। তখন স্পষ্ট দেখা যায় দূরের বা কাছের জিনিস।
এই যে, শোনো
অন্যের কথাবার্তা, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, রেডিওর গান-সবই তুমি শুনতে পাও। কোনটা কিসের শব্দ তাও তুমি বুঝতে পার। করণ তোমার কান ও মস্তিষ্ক একযোগে কাজ করে।

শব্দ হচ্ছে বাতাসের মধ্যকার তরঙ্গ। শব্দতরঙ্গ ভেসে ভেসে তোমার কানের মধ্যে ঢুকে কানের পর্দায় ধাক্কা দেয। এই শব্দতরঙ্গে তোমার কানের পর্দা কেঁপে ওঠে। কানের পর্দা যখন কাঁপে, তখন ওটা তিনটি ছোট হাড়কে পর পর আঘাত করে। এই তিনটি হাড়ের প্রথমটি হাতুড়ির মতো, দ্বিতীয় হাড়টি কামারের নেহাই এর মতো। যে সমান জিনিসের ওপর রেখে কামার গরম লোহা পিটায় তাকে বলে নেহাই। আর তৃতীয়টা অশ্বারোহীদের পাদানির মতো। এই তৃতীয় হাড়টা কানের ভেতরে শামুকের মতো দেখতে কোকলিয়ার ভেতরে যায় আর আসে।

এই কোকলিয়ার ভেতরে আছে এক ধরনের তরল পদার্থ ও স্নায়ু। তৃতীয় হাড়টা যখন কোকালিয়ার ভেতরে যাতায়াত করে, তখন ওই তরল পদার্থের ভেতরে এক ধরনের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। সে তরঙ্গ যায় স্নায়ু পর্যন্ত। স্নায়ু ওই তরঙ্গ থেকে বার্তা নিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। মস্তিষ্কে তোমাকে জানায় যে, শব্দ হচ্ছে।

তবে কান শুধু তোমাকে শুনতেই সাহায্য করে না, তোমার শরীরের ভারসাম্য রক্ষায়ও কান বিরাট ভূমিকা পালন করে। যখন তুমি চলা ফেরা করো কিংবা দাঁড়িয়ে থাক, তখন কানই তোমার শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে। কানের ভেতরে শামুকের মতো কোকলিয়ার ওপরের দিকে আছে তিনটি টিউব। ওগুলোও তরল পদার্থে ভরা। এই টিউবই ভারসাম্য নালী। এই তিনটি টিউবেরই নিচে আছে ছোট ছোট লোমঅলা কোষ। কোষের লোমগুলো টিউবের গায়ে জড়িয়ে থাকে। এই কোষের প্রতিটি লোম গিয়ে মিলছে এক একটি স্নায়ুর সঙ্গে। এই স্নায়ু মস্তিষ্কে বার্তা পাঠায়। মস্তিষ্ক ফিরতি বার্তা পাঠায় পেশীগুলোতে। এর ফলে তুমি যখন হাঁটো, লাফাও, দৌড়াও বা সাঁতার কাটো তখন পেশীগুলো শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।
আঙ্গুলের ডগায়
আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়েই তুমি বরে দিতে পার আলপিনের মাথা তীক্ষè আপেল মসৃণ, বরফ ঠান্ডা, বারিশ নরম। এসব বলতে পার তোমার আঙ্গুলের স্নায়ুর কারণে।

তোমার আঙ্গুলের স্নায়ুগুলি খুব ঘন। সে কারণে আঙ্গুল দিয়ে তুমি এত কিছু অনুভব করতে পার। ধরা যাক, গরমের মধ্যে তুমি ঘন ঘন বাইসাইকেলের বেল বাজাচ্ছো। তোমার আঙ্গুলের কোন কোন স্নায়ু বলে দেবে বেলটি খুব গরম, অন্য স্নায়ুরা বলবে বেলটি খুব মসৃণ, আর একদল স্নায়ু বলবে বেলটি খুব শক্ত। এবং অন্য আরেক দল বলবে জোরে জোরে বেল বাজাতে তোমার হাত ছড়ে গেছে।

তোমার শরীরের সকল অংশ একইভাবে অনুভব করতে পারে না। যেমন তোমার পিঠের স্নায়ু একটা থেকে আর একটা বেশ দূরে। দুটি পেন্সিলের সাহায্যে এটা তুমি প্রমাণ করতে পার। চোখানো হয়নি এমন দুটি পেন্সিল নাও। এবার তোমার কোন বন্ধুর পিঠে কাছাকাছি জায়গায় পেন্সিল দুটি দিয়ে একই সঙ্গে সমান জোরে চাপ দাও। তোমার বন্ধু শুধু একটি পেন্সিলের চাপের কথা বলতে পারবে। কিন্তু দুটি পেন্সিল যদি বেশ দূরে নিয়ে চাপ দাও, তবে সে দুটির কথাই বলতে পারবে।
সুন্দর ঘ্রাণ
তুমি যখন স্ট্রবের ফলের ঘ্রাণ নাও, তখন কি ঘটে? স্ট্রবেরির সামান্য অংশ ভেঙে বাতাসে ছড়িয়ে থাকে। এ অংশ এতই ক্ষুদ্র যে খালি চোখে দেখা যায় না। এগুলো স্ট্রবেরির অণু। তুমি দেখতে না পেলে কি হবে, তোমার নাক ঠিকই ওই অণুগুলোকে বাতাস থেকে ধরে ফেলে।

তোমার নাকের ভেতরে আছে চুলের মতো অসংখ্য স্নায়ু। স্ট্রবেরির ঐ অণুগুলো যখন তোমার নাসারন্ধ্রে ঢোকে, তখন স্নায়ুরা তোমার মস্তিষ্কে বার্তা পাঠায়। মস্তিষ্ক তোমাকে জানায়, তুমি স্ট্রবেরির ঘ্রাণ নিচ্ছ। তুমি যে ঘাণই নাও না কেন, তার জন্য তোমার মস্তিষ্ক আর নাক একযোগে কাজ করে। তুমি যখন কোন সু¯^াদু খাবারের গ্রাণ পাও, তখন মস্তিষ্ক তোমার মুখ ও পাকস্থলিকে খবর দেয়। তার ফলে খাবার মুখে দেয়ার আগেই তোমার জিভে পানি আসে, আর পাকস্থলিও রস তৈরি করতে শুরু করে।

ঘ্রাণ নেবার জন্য সাপ তার জিভ ব্যবহার করে। সাপ ঝট করে জিভ মুখের বাইরে বের করে দিয়ে বাতাসে ঘুরিয়ে নেয়। বাতাস থেকে সে জিভে করে বয়ে নেয় বিভিন্ন জিনিসের অণু। এরপর সে জিভটি তার মুখের তালুর ওপর ছোট গর্তে ঢুকিয়ে য়ে। ওই গর্তে আছে স্নায়ু। স্নায়ু তখন ওই অণুর খবর সাপের মস্তিষ্কে পাঠায়। সাপ বুঝতে পারে সামনে বিপদ আছে, না খাদ্য
স্বাদ কেমন?

কোন কোন জিনিস খেতে তুমি পছন্দ কর। আর কোন কোনটা তোমার একেবারেই পছন্দ নয়। কারণ ওগুলোর স্বাদ কী রকম সেটা তুমি জান। তুমি মুখের ভেতরে যে খাবারই নাও না কেন, তোমার জিভ সেটাকে মুখের ভেতরে ঘোরায়। এর ফলে তুমি জিনিসটার স্বাদ বুঝতে পার।

তোমার জিভের ডগা, দুই পাশ এবং গোড়ার দিকটায় আছে খুব ছোট ছোট ঘামাচির মতো মাংসপিন্ড। এই মাংসপিন্ডের কোন কোনটার মুখে আছে সূ² ছিদ্র। তার ভেতরে আছে টেস্ট-বাড বা স্বা গ্রহণ করার কোষ। এক এক ধরনের কোষ এক এক রকম স্বা গ্রহণ করতে পারে। জিহ্বার এক এক অংশ এরা থাকে দলবদ্ধভাবে। জিহ্বার  গোড়ার দিকে টেস্ট-বাডগুলো কেবল তিতা স্বা গ্রহণ করতে পারে। জিহ্বার দুপাশের টেষ্ট বাডগুলো গ্রহণ করতে পারে টক স্বা। একেবারে সামনে দুপাশের টেস্ট-বাড গ্রহণ করে লোনা স্বা। জিহ্বার আগা গ্রহণ করে মিষ্টি স্বা। এই টেস্ট-বাডগুলোর ভেতরে আছে স্নায়ু। স্নায়ু বার্তা পাঠায় মস্তিষ্কে। মস্তিষ্ক তোমাকে বলে, কী স্বা নিচ্ছ।

তোমার ঠোঁট, জিহ্বার দাঁত ও চোয়ালের কোষগুলো তোমাকে জানায়, তুমি কী খাচ্ছ। তারা তোমার মস্তিষ্ককে জানায়, তুমি যে খাবার খাচ্ছ তা ঠান্ডা না গরম, শক্ত না নরম, খসখসে না মসৃণ।
তোমার দাঁত
তোমার দাঁতের বয়স কত? তোমার থেকে সামান্য কয়েক মাস কম। যখন তুমি জন্ম গ্রহণ করেছ, তখন তোমার দাঁত ছিল না। তবে যেখানে যেখানে এখন দাঁত উঠেছে, সেখানে তেমার মাড়ির নিচে ছিল কুঁড়ির মতো লুকানো দাঁত। যখন তোমার বয়স মাত্র ছয় মাস, তখন তোমার দুধ দাঁত উঠতে শুরু করে। তোমার বয়স যখন তিন বছর, ততক্ষণে ২০টি দুধ দাঁত উঠে গেছে। তোমার বয়স যখন প্রায় ছয় বছর তখন তোমার মূল দাঁত উঠতে শুরু করে। একটি একটি দুধ দাঁতকে ওপরের দিকে ঠেলে দিয়ে উঠতে থাকে এক একটি মূল দাঁত। তখন দুধ দাঁত ড়ে এবং সেগুলোকে বড় কেউ তুরে দেয়। আস্তে আস্তে েেকর পর এক মূল দাঁত উঠতে থাকে। আর দাঁতগুলোকে জায়গা করে দেবার জন্য বড় হতে থাকে তোমার চোঁয়াল। এভাবে ¦কে সময় সারা মুখে তোমার ৩২টি দাঁত গজায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার দাঁতগুলোকে দেখ। সবগুলো কি একই রকম? না। কারণ মুখের ভেতরে এক এক দঁতের এক এক কাজ। সামনের দাঁতগুলো খাদ্য কাটার জন্য বিশেষভাবে তৈরি, এদের বলে কর্তন দাঁত। এর পাশের দাঁতগুলোর মাথা চোখা। এদের বলে ছেদন দাঁত। এই দাঁতের সাহায্যে খাদ্য আটকিয়ে চিরে ফেলতেদ পার তুমি। তারপরে মুখের ভেতরের দিকের দাঁতগুলোর ওপরের অংশ প্রায় সমান। এগুলোকে বলে পেষণ দাঁত। খাবার চিবানোর সময় সবগুলো দাঁত এক সঙ্গে কাজ করে যাতে খাদ্য টুকরা টুকরা হয়।

দাঁতের প্রধান শক্রু প্লাক। দাঁতের ফাঁকে খাদ্য জমে থাকলে তার মধ্যে  এই প্লাক জন্মে। এই প্লাক প্রথমে এসিড তৈরি করে দাঁতের এনামেল নষ্ট করে দেয়। দুই বেলা নিয়মিত ভাল করে দাঁত ব্রাশ করলে দাঁতের রোগ হয় না।
পরিচ্ছন্ন থেকো
প্রথমেই তাকাও তোমার দুহাতের নখের দিকে। নখগুলো কি ছোট এবং পরিষ্কার? নাকি লম্বা এবং তার নিচে ময়লা? হাত ধুয়েছ কতক্ষণ আগে?
হয়ত ভাবছ, ফিটফাট থাকা তো বড়দের ব্যাপার। কিন্তু না, শরীর জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য তোমারও সব সময় পরিষ্কার পরচ্ছন্ন ও ফিটফাট থাকা দরকার। খেলো, কাজ করো বা দোকানে যাও, সেখান থেকে তোমার হাতে ময়লা লাগবেই। ঐ ময়লা যদি যায় তোমার খাবারে, তাহলে সহজেই জীবাণু ঢুকবে তোমার শরীরে। সে জন্য অপরিস্কার আঙ্গুল কখনও চুষবে না, দাঁত দিয়ে নখ কাটবে না। হাত চুষলে বা দাঁত দিয়ে নখ কাটলেও রোগ জীবাণু ঢুকতে পারে তোমার শরীরে।

পায়খানা-প্রস্রাবেও থাকে লক্ষ লক্ষ জীবাণু। সুতরাং টয়লেটে গেলে, বের হওয়ার আগে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নখের নিচের ময়লা পরিষ্কার করা উচিত। তবে তোমার হাতই শুধু ময়লা হয় না, তোমার শরীরের ত্বকও নানা কারণে ময়লা হয়। গরমে তুমি ঘামো। ঘামের বেশির ভাগই পানি। কিন্তু ঘাম যদি ধুয়ে না ফেলো, তবে ঘাম শুকিয়ে গিয়ে শরীর দুর্গন্ধ হবে। তাই প্রতিদিনই তোমার গোসল করা উচিত।

আরও একভাবে শরীরে রোগজীবাণু ঢুকতে পারে। তুমি যখন হাঁচি বা কাশি দাও, তখন বের হয় এক ধরনের তরল পদার্থ। ওগুলোও থাকে রোগজীবাণুতে ভরা। তাই হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় মুখ রুমাল, টিস্যু বা হাত দিয়ে ঢেকে ফেলবে যাতে সেটা অন্য কারও শরীরে না লাগে, বা অন্য কেউ নিঃশ্বাসের সঙ্গে টেনে না নেয়। হাঁচি-কাশি যদি হাত দিয়ে রোধ করো, তা হলে হাত ধুয়ে ফেলবে সাবান দিয়ে। গৃহপালিত প্রাণীও অনেক সময় রোগজীবাণু ছড়ায়। তাই পোষা কুকুর বা বেড়ালকে তোমার শরীর চাটতে দিও না। এদের নিয়ে খেলা করার পর সব সময় হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলবে।

আর দাঁত পরিষ্কার রাখা খুব জরুরী। দাঁতে ময়লা থাকলে শুধু যে দাঁতের ক্ষতি হয়, তাই নয়, নিশ্বাস বাজে গন্ধও হয়। দাঁত পরিষ্কার থাকলে তোমার সব সময় ফ্রেশ লাগবে।

তোমার বোধ হয় মনে হচ্ছে, পরিচ্ছন্ন থাকার তালিকা এত লম্বা! কিন্তু খুব সহজেই তুমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পার। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে তোমার মন ভাল থাকবে। তোমার শরীর থাকবে সুস্থ।
জন্মের আগে
কোথায় ছিলে জন্মের আগে? ছিলে মায়ের পেটে, উষ্ণ ও নিরপদ জায়গায়। জায়গাটা তোমার মায়ের পাকস্থলির নিচে। একে বলে জরায়ু বা গর্ভ। কিন্তু তুমি ওখানে গেলে কীভাবে?

তোমার মায়ের শরীরের ভেতরে আছে বিশেষ ধরনের কোষ। ওটাকে বলে ডিম্বাণু। ওটা কুব ছোট। তুমি তোমার পেন্সিল দিয়ে যত ক্ষুদ্র চিহ্ন দিতে পার, তার চেয়েও ছোট। তোমার বাবার শরীরের ভেতরে আছে আর এক বিশেষ ধরনের কোষ। যাকে বলে শুক্রাণু। এটা ডিম্বাণুর চেয়েও ছোট। দেখতে অনেকটা ব্যাঙাচির মতো।

তোমাকে তৈরি করতে তোমর বাবার শুক্রাণু তোমার মায়ের ডিম্বাণুর সঙ্গে একত্রিত হয়। এই দুটি কোষ তখন একটি কোষে পরিণত হয়। আর তখন থেকেই একটা নতুন প্রাণ সৃষ্টি হতে শুরু করে।

শীগগীর ওই কোষ একটি ভেঙে দুটি হয়। ২টি ভেঙে ৪টি হয়, ৪টি ভেঙে ৮টি, ৮টি ভেঙে ১৬টি। এভাবে বাড়তে থাকে জেলীর মতো কোষ। যতই বাড়, তারা সবগুলো থাকে একসঙ্গে জড়াজড়ি করে। আর অবিরাম বাড়তেই থাকে।

প্রথম প্রথম সকল কোষ দেখতে প্রায় একই রকম থাকে। কিন্তু কিছুকাল পরই প্রতিটি কোষ আলাদাভাবে কাজ শুরু করে। কেউ হয়ে যায় ত্বক কোষ, কেউ হাড় কোষ, কেউ হৃদপিন্ড কোষ, কেউ বা হয় মস্তিষ্ক কোষ।
জন্ম গ্রহণের অপেক্ষায়
জন্ম গ্রহণ করার আগে তোমার শরীর গঠিত হয়েছে ধীরে ধীরে। ওই সময় তুমি ছিলে মায়ের গর্ভে। সেখানেই ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। তুমি যতই বড় হয়েছ, তোমার মায়ের গর্ভের আকারও তত বড় হয়েছে, যাতে ওখানে থাকতে তোমার কোন কষ্ট না হয়। সেখানে তুমি ছিলে উষ্ণ নিরাপদ। তোমার শরীর নাড়ির মাধ্যমে যুক্ত ছিল তোমর মায়ের শরীরের সঙ্গে। নাড়িটা ছিল তোমার নাভির সঙ্গে লাগানো। এ পথে মায়ের শরীর থেকে খাদ্য গিয়েছে তোমার শরীরে।

কিছুটা বড় হওয়ার পর তুমি মায়ের পেটের মধ্যে নড়াচড়া করেছ। তোমার মা তোমার নড়াচড়া টের পেয়েছেন। তুমি পা ছড়িয়ে দিয়ে লাথি মেরেছ। তোমার মা হাসি মুখে পেটের বাইরে ওই পা ছুঁয়ে দিয়েছেন। এভাবে নয় মাস মায়ের গর্ভে কাটানোর পর তুমি জন্ম নিয়েছ। তখন তোমার নাভির গোড়া থেকে নাড়ি কেটে দিয়ে তোমাকে আলাদা করা হয়েছে।
ছোট্ট তুমি
তুমি ছিলে ক্ষুধার্ত। কিন্তু কথা বলতে পারতে না। তা হলে তোমার ক্ষুধা লাগলে জানাতে কীভাবে? তখন তোমার সকল প্রয়োজনের কথা জানাবার একমাত্র পথ ছিল কান্না, কেবল কান্না। বেশির ভাগ নবজাতক শিশু শুধু কাঁদে। কেবল কান্নার মাধ্যমে তারা আশপাশের সকল লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে চায়। তোমার জীবনের প্রথম কয়েক মাস তোমার কিছুই করার ছিল না। তখন তুমি কেবল কেঁদেছ, ঘুমিয়েছ আর খেয়েছ্ তারপর তুমি দিনে আরও কিছু বেশি সময় জেগে থেকেছ। তুমি গোসল করতে ভালবেসেছ। গোসলের সময় হাত-পা ছুঁড়তে পছন্দ করেছ।

তুমি আস্তে আস্তে আরও বড় হয়েছ। তোমার নাম জেনেছ। কেউ তোমার নাম ধরে ডাকলে তুমি মাথা উঁচু করে সাড়া দিয়েছ। এভাবে বড় হয়েছ আর শিখেছ। খাওয়ার সময় ঘড়ঘড় শব্দ করেছ। নিজের আঙ্গুল নিয়ে খেলা করেছ। তারপর বসতে শিখেছ। তোমার চারপাশ দেখতে শিখেছ। লোকে বলেছে, ‘বাঃ শিশুটা বেশ বড় হচ্ছে
বড় হয়েছে হাড়
ছোট্ট বাচ্চাকে কি কখনও কোলে নিয়েছ? তোমার কি মনে হয়েছে শিশুটির শরীর এত নরম কেন? এর একটি কারণ: বাচ্চাদের হাড় শক্ত নয়। শিশু যখন জন্ম গ্রহণ করে তখন তার শরীরের মাত্র কয়েকটি হাড় শক্ত নয়। শিশু যখন জন্ম গ্রহণ করে তখন তার শরীরের মাত্র কয়েকটি হাড় শক্ত থাকে। বাকী সব হাড় থাকে নরম, এদের বলে কোমলাস্থি। কিন্তু হাড়ের কোষগুলি সারাক্ষণ কাজ করে। ফলে শিশুদের হাড় বাড়তে থাকে এবং শক্ত হতে থাকে। তোমার হাড়ও শিশুর হাড়ের চেয়ে বড় ও শক্ত। তবে তোমারটাও বয়স্ক মানুষের হাড়ের মতো শক্ত নয়। প্রায় ২১ বছর বয়স পর্যন্ত তোমার হাড়ও বাড়তে থাকবে এবং শক্ত হতে থাকবে।

শিশুদের হাড় কীভাবে বাড়ছে, সেটা পরীক্ষা করতে ডাক্তাররা অনেক সময় তাদের কব্জি এক্স-রে করে দেখেন। কোন কোন শিশুর কব্জির হাড় তাড়াতাড়ি বাড়ে। কারও বাড়ে ধীরে ধীরে। সবচেয়ে ভাল হয় ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পাওয়া। কব্জির হাড় যদি নিচের এক্স-রে ছবির মতো বাড়তে থাকে, তবে বুঝতে হবে, হাড় ঠিক ভাবেই বাড়ছে।

১.     সদ্যজাত শিশুর কব্জিতের হাড় গঠিত হয় নি। ২. এক বছরের শিশুর হাতের এক্সরে প্লেট। হাড় তেমন শক্ত হয় নি। ৩. চার বছরে গঠিত হয়েছে তিন-চারটি কব্জির হাড়। ৪. সাত বছর বয়সে গঠিত হয়েছে কব্জির ছয়টি হাড়। ৫. সতের বছর বয়সে কব্জির সব হাড়ই গঠিত হয়।
তুমি কতটুকু লম্বা হবে
তুমি কেবলই রম্বা হচ্ছ। এই লম্বা হওয়ার কাজটা সবচেয়ে সহজ। কারণ তোমাকে কিছুই করতে হচ্ছে না। এটা ঘটছে। কীভাবে ঘটছে, সেটা তুমি দেখতেও পারছ না। গত বছর তুমি কতটুকু লম্বা ছিরে, এবছর বেড়েছ সামান্য বেশি। হয়ত চোখে পড়ছে না সবার। কিন্তু গত বছরের কাপড়-চোপড় কিন্তু এবছর আর গায়ে লাগছে না। ছোট হয়ে গেছে।

কীভাবে ঘটছে এটা? তোমার শরীরে আছে কোটি কোটি কোষ। প্রতিটি কোষই প্রতিদিন বড় হচ্ছে। এরপর একটি কোষ ভাগ হয়ে দুটি হচ্ছে, দুটি হচ্ছে চারটি, চারটি হচ্ছে আটটি। এভাবে বাড়ছেই।

প্রতিদিন তোমার পেশীতে নতুন কোষের জন্ম হচ্ছে। সেগুলোও আবার ওপরের নিয়মে বাড়ছে। তোমার হাড়েরও একই অবস্থা। কোষ বাড়ছে। সুতরাং প্রতিদিন তুমি একটু না একটু লম্বা হচ্ছেই।

তাহলে মানুষ কেন সারা জবিন ধরে লম্বা হয় না? তার একটি কারণ তোমার শরীর কোষ তৈরি করলেও, এক সময় কিছু কোষ মরে যেতে থাকে।
আরও একটি কারণ হল তোমার দেহের লালগ্রন্থি। চোখের পানি, ঘাম, চর্বি, খাদ্য হজমে সহায়ক লালগ্রন্থি আছে তোমার শরীরে। আর আছে তোমাকে রোগ থেকে রক্ষা করার গ্রন্থি, তোমার হৃদস্পন্দন বাড়ানোর গ্রন্থি এবং তোমার শরীর বৃদ্ধির গ্রন্থি।

এই লালাগ্রন্থিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে একটি গ্রন্থি। এর নাম পিটুইটারি গ্রন্থি। এই গ্রন্থি অন্য সকল গ্রন্থিকে একযোগে কাজ করার নির্দেশ দেয়। পিটুইটারি গ্রন্থিগুলো এমন সব রসায়ন নিঃসরণ করে, যাতে তুমি লম্বা হও। এরা এমন কাজও করতে পারে যাতে তুমি আর লম্বা না হও।

ষোল থেকে তেইশ বছর বয়সের কোন এক সময় তোমার লালাগ্রন্থিগুলো শরীরকে বলে আর বেড়ো না, এবার ক্ষান্ত হও। ব্যস, বন্ধ হয়ে যাবে লম্বা হওয়া। ইতিমধ্যে তোমার পা হবে জন্মের সময়ের চেয়ে পাঁচগুন বড়, হাত হবে চারগুন আর মাথা হবে দ্বিগুন বড়।
তোমার শরীরের পরিবর্তন
শিশুদের চেয়ে বড়দের অন্য রকম দেখায়। অবশ্যই তারা বড়সর। কিন্তু তারা নানা ভাবে আলাদা হয়ে ওঠে। মেয়েদের বয়স যখন প্রায় ১২ বছর হয়, তখন তাদের শরীরের বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। তাদের মুখ, উরু এবং নিতম্ব গোলগাল হতে শুরু কর্ েকারণ এসময় তাদের ত্বকের নিচে এক পরত চর্বি জমে। তাদের শরীরেও আসে নানা পরিবর্তন।

ছেলেদের শরীরে পরিবর্তন ঘটতে থাকে প্রায় চৌদ্দ বছর বয়স থেকে। তাদের দাঁড়ি-গোফ জন্মাতে থাকে। তাদের কণ্ঠস্বর গাঢ় হয় এবং কাঁধ বড় হতে থাকে। তাছাড়া শরীরে আরও পরিবর্তন দেখা দেয়।

এই পরিবর্তন ঘটে ধীরে ধীরে, কয়েক বছর ধরে। শিশুরা যখন পূর্ণবয়স্ক মানুষে পরিনত হয়, তখন তারা নিজেদের শিশু তৈরি করার উপযুক্ত হয়। তবে শরীর উপযুক্ত হওয়াই কিন্তু যথেষ্ট নয়। সন্তান জন্ম দেবার জন্য দরকার মনের পরিপক্কতা। দরকার উপযুক্ত শিক্ষা। শরীর ও মন উভয়ই পরিপক্ক হলে তোমরা তোমাদের সন্তান তৈরির সিদ্ধান্ত নেবে।

তুমি যখন জন্মেছ, তখন তোমার পিতা-মাতা ছিল পূর্ণবয়স্ক। তুমি যখন পূর্ণ বয়স্ক হবে, তখন তোমার পিতা-মাতা হবে প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ। আবার যখন তোমার সন্তানেরা পূর্ণ বয়স্ক হবে তখন, তুমিও হবে প্রৌঢ়। এভাবেই চলছে পৃথিবীতে মানুষের জীবনচক্র।
দেখতে তুমি কার মতো?

বড় হলে তুমি দেখতে কার মতো হবে, ভেবে দেখেছ? দেখতে তোমার বাবার মতো হবে? তার মত লম্বা? নাকি দেখতে হবে তোমার মায়ের মতো? তুমি সম্ভবত দেখতে হবে কিছুটা তোমার বাবার মতো এবং কিছুটা তোমার মায়ের মতো। দেখতে তোমার দাদা-দাদাীর মতোও কিছুটা হতে পার।

এটা হতে পারে এক কারণে। তোমাকে সৃষ্টির জন্য তোমার মায়ের ডিম্বাণু ও বাবার শুক্রাণু মিলে যে কোষ গঠিত হয়েছিল, তার ভেতর দিয়ে দুজনের ইত্তরাধিকার তুমি বয়ে এনেছ। একে বলে বংশগতি। বাবা-মায়ের ওই দুইটি কোষের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশের নাম জিন। প্রত্যেক জিনেরই আলাদা আলাদা কাজ আছে। কোনটা ঠিক করে চুলের রঙ, কোনটা চোখের রঙ। কেউ বা ঠিক করে দেয, তুমি কতটা লম্বা হবে। তোমার শরীরের বিভিন্ন অংশ কিভাবে গঠিত হবে, ঐ জিন তার সকল তথ্য বহন করে। তুমি কী রকম বিমেষ ধরনের মানুষ হবে, জিন সে কথা তোমার শরীরেকে জানিয়ে দেয়।

এসব জিনের কোন কোনটা এসেছে হেতামার মায়ের কাছ থেকে, কোন কোনটা তোমার বাবার কাছ থেকে ফেলে তোমার শরীরের জিনগুলি তোমার বাবা-মার জিনের একটা মিশেল। যেহেতু তোমার বাবা ও মায়ের জিন এসেছে, তোমার দাদা-দাদী ও নানা-নানীর জিন থেকে, তাই তোমার চেহারার খানিকটা তাদের মতোও হতে পারে। এই সকল জিন মিলেমিশে বিশেষভাবে তোমাকে তৈরি করেছে।

তোমার বাবা-মার কাছ থেকে তুমি যে জিন পেয়েছ তারা তোমার চুলের রঙ ঠিক করে দেয়। সাধারণত গাঢ় রঙের চুলের জিন হালকা রঙের জিনগুলোর ওপর জয়ী হয়।
প্রশ্ন জাগে মনের ভেতর

যত বড় হবে, ততই সারা দিন তোমার মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাবে। এটা কেন, ওটা কি, সেটা কোথায়? মাঝে মাঝে তোমার মনে হয়, স্কুল থেকে ঘরে ফেরার আগেই পোষা কুকুর কেমন করে টের পায় তুমি এসে গেছ। নখ বা চুল কাটলে কেন ব্যথা লাগে না? কেন তুমি হাই তোলোএসব প্রশ্ন জবাব পাও তুমি দেখে, বই পড়ে কিংবা অন্যদের কাছে জিজ্ঞাসা করে। এভাবেই তুমি জেনে গেছ, কুকুরের আছে অত্যধিক প্রখর ঘ্রাণশক্তি। সে পাশাপাশি দুটি পায়ের চিহ্ন শুঁকে আলাদা করে বলে দিতে পারে কোনটি কার পায়ের ছাপ। চুল ও নখে যেহেতু কোন স্নায়ু নেই, তাই নখ-চুল কাটলে ব্যথা লাগে না।
শরীরের যেখানে স্নায়ু আছে, সে জায়গায় কাটলে ব্যথা লাগে। তুমি জেনেছ যে, ক্লান্ত থাকলে মানুষ হাই তোলে। হাই তুলে তুমি যে অতিরিক্ত বাতাস টেনে নিচ্ছো ফুসফুসে, সেটা তোমার শরীরে অতিরিক্ত অক্সিজেনের জোগান দেয়, যা তোমাকে জেগে থাকতে সাহায্য করে।

তুমি এরকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর পেয়েছ। উত্তর পেয়েছ, কারণ তোমার মা আছে। তোমার মনে হতে পারে, কেন তোমাকে বানানো হল, বেঁচে থাকা বলতে কী বোঝায়? তুমি কীভাবে জানতে পারলে বিষয়টা ভুল না সঠিক? তোমার মা-বাবা আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধব যে কাউকে জিজ্ঞেস করে এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে নিতে পার তুমি।
তোমার পরিবার
তুমি, তোমার ভাই-বোন ও বাবা-মা মিলে তোমার পরিবার। তাছাড়া পরিবারে থাকেন দাদা-দাদী, নানা-নানী, চাচা-ফুফু, মামা-খালা। কখনও কখনও এদের অনেকে থাকে একত্রে। কখনও বা তোমরা ভাই-বোন এবং বাবা-মা মিলে সংসার। সংসার যাই হোক, পরিবার আকারে বড় হতে পারে।

পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আছে নানা ধরনের দায়িত্ব। পরিবারের প্রত্যেকেই পরস্পরের জন্য কিছু না কিছু করেন। তারা কারও জন্য দুঃখিত, কারও জন্য আনন্দ-গবৃ করেন। তারা একসঙ্গে খেলে ও কাজ করে। তারা বিপদে আপদে একে অপরকে সাহায্য করে। পৃথিভীর এক এক দেশে পারিবারিক ব্যবস্থা এক এক রকম। কিন্তু তারা সকলেই পরস্পরের জন্য কাজ করে।
বন্ধু-বান্ধব

কার কাছে তুমি মনের গোপন কথাটা বলো? কাকে শোনাও প্রিয় জোক? খেলতে যেতে চাও কাদের সঙ্গে? নিশ্চয়ই তোমার সবচেয়ে ভাল বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধু তাদের বলে, যাদের তুমি ভাল করে চেনো এবং যাদের সঙ্গে চলতে নিরাপদ বোধ কর। তোমার বাবা-মাও নিশ্চয়ই বলেছে, সবাই বন্ধু হয় না। দেখেশুনে বন্ধু-বান্ধব ঠিক করে নেবে। এ জন্যই বন্ধুরা গুরুত্বপূর্ণ। তুমি তোমার বন্ধুদের ওপর যেন নির্ভর করতে পার। বন্ধুদের সঙ্গেও কখনও কখনও তর্কাতর্কি হয়। কিন্তু সে রাগ তুমি বেশি দিন পুষে রাখো না। তুমি জানো, বন্ধুরা তোমাকে সত্যি সত্যি কষ্ট দিতে চায়নি।

কোন গুণের জন্য কে তোমার বন্দু হয়েছে, ভেবে দেখেছ? একজন তোমার বন্ধু হয়েছে, কারণ তার সঙ্গে মজা করা যায়। আর একজন বন্ধু হয়েছে, কারণ তুমি যখন কথা বলতে চাও, সে মনোযোগ দিয়ে শোনে। এরকম বিশেষ কোন না কোন গুণ আছে তোমার সকল বন্ধুর। তবে ভুলে যেও না, তুমিও কিন্তু তাদের একজন বন্ধু।

বন্ধু-বান্ধব
কার কাছে তুমি মনের গোপন কথাটা বলো? কাকে শোনাও প্রিয় জোক? খেলতে যেতে চাও কাদের সঙ্গে? নিশ্চয়ই তোমার সবচেয়ে ভাল বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধু তাদের বরে, যাদের তুমি ভাল করে চেনো এবং যাদের সঙ্গে চলতে নিরাপদ বোধ কর। তোমার বাবা-মাও নিশ্চয়ই বলেছে, সবাই বন্ধু হয় না। দেখেশুনে বন্ধু-বান্ধব ঠিক কের দেবে। এ জন্যই বন্ধুরা গুরুত্বপূর্ণ। তুমি তোমার বন্ধুদের ওপর যেন নির্ভর করতে পার। বন্ধুদের সঙ্গেও কখনও কখনও তর্কাতর্কি হয়। কিন্তু সে রাগ তুমি বেশি দিন পুষে রাখো না। তুমি জানো, বন্ধুরা তোমাকে সত্যি সত্যি কষ্ট দিতে চায়নি।

কোন গুণের জন্য কে তোমার বন্ধু হয়েছে, ভেবে দেখেছ? একজন তোমার বন্ধু হয়েছে কারণ তার সঙ্গে মজা করা যায়। আর একজন বন্ধু হয়েছে, কারণ তুমি যখন কথা বলতে চাও, সে মনোযোগ দিয়ে শোনে। এরকম বিশেষ কোন না কোন গুন আছে তোমার সকল বন্ধুর। তবে ভুলে যেও না, তুমিও কিন্তু তাদের একজন বন্ধু।
অনুভূতি

তুমি বড় হতে থাকলেও তোমার মুখের কিন্তু তেমন একটা পরিবর্তন হয় না। মুখটা একটু বড় ও পাতলা হয়। তবে তোমাকে কিন্তু তোমার মতোই দেখায়।
তোমার আঙ্গুলের চাপ কখনও পরিবর্তিত হয় না। তবে ঘন্টায় ঘন্টায় দিনে দিনে তোমার একটা জিনিসের পরিবর্তন হয়, সেটা তোমার অনুভূতি। তুমি হতে পার আনন্দিত, দুঃখিত, উত্তেজিত, শান্ত, অমায়িক, লাজুক, ভীরু কিংবা সাহসী। এই মুহূর্তে তোমার হঠাত মনে হতে পারে, তুমি বড় হয়ে গেছ, পর মুহূর্তে তুমি শিশুদের মতো আচরণ করে বসতে পার। এভাবেই মানুষ বড় হয়ে ওঠে। কখনও কখনও এসব অনুভূতি এবেবারে তালগোলও পাকিয়ে ফেলে।

ক্রোধের অনুভূতি ভাল নয়। কারণ এতে মনের ভেতর কষ্ট হয়। নানা কারণেই তোমার রাগ হতে পার্ েকেউ অন্যায় তর্ক কররে রাগ হতে পারে, কেউ খারাপ আচরণ করলে রাগ হতে পারে। তোমার অপছন্দের কোন কাজ করতে বাধ্য করলে রাগ হতে পারে। এসব কারণে তুমি চিতকার করে হৈ-চৈ বাঁধিয়ে ফেলতে পার। কিন্তু ক্রুদ্ধ হলে তোমার পরে মনে হবে, না ওরকমটি তুমি করোনি, করা উচিত হয়নি। এর ফলে তোমার কষ্ট বাড়তে থাকবে। এ থেকে তুমি অবশ্য বুঝতে পারবে যে, কোন বিশেষ ঘটনায় কখনও কখনও প্রায় সবারই একই রকম অনুভূতি হয়।

প্রিয় কাউকে হারানো
তোমর কি কোন পোষা প্রাণী আছে, যেটা মারা গেছে? তোমার নিশ্চয়ই কষ্ট হয়েছে। তুমি কখনও পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেলে যে কষ্ট হয়, এ কষ্ট তার থেকে আলাদা। তোমর পোষা প্রাণীটর মৃত্যুর অর্থ হর, তুমি তাকে আর কখনও দেখতে পাবে না, আদর করতে পারবে না। তবে শুধুমাত্র পোষা প্রাণীই মারা যায় না। মারা যায় মানুষ। এমন মানুষও মারা যায় যাকে তুমি পছন্দ কর, ভালোবাস। এর অর্থ তুমি আর কখনও তাকে দেখতে পাবে না। এটা খুবই কষ্টকর। তবে মৃত্যু জীবনের বাস্তব সত্য। প্রত্যেককেই কোন না কোনদিন মারা যেতে হবে। তবে যাদের আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব মারা যায, এই মৃত্যু তাদের জন্য হয় খুব বেদনাদায়ক। যারা মরে যায়, তারা চলে যায়, হারিয়ে যায়। এতে তাদের স্বজনরা বড় নিঃসঙ্গ ও দুঃখিত বোধ করেন। মানুষ যখন খুব বুড়ো হয় তাদের শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, স্নায়, গ্রন্থি, মস্তিষ্কের কাজ শিথিল হয়ে আসে। অবশেষে একটি পুরনো জরাজীর্ণ মেশিনের মতো তার শরীর কাজ বন্ধ করে দেয়। সে মারা যায়। তবে শুধুমাত্র বুড়োরাই মারা যায় না, কখনও কখনও মারা যায় শিশু কিংবা যুবক বয়সী বাবা বা মা। এর কারণ হতে পারে, তাদের শরীর কাজ করছিল না ঠিক মতো। হতে পারে তারা কোন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

যে যেভাবেই মারা যাক, তার নিকট আত্মীয়দের কাছে এটা খুবই কষ্টের। এদের মধ্যে অনেকে নির্বাক শান্ত হয়ে যায়। অনেক দিনের জন্য। কেউ কেউ শোকে ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। কিছু মেনে নিতে পারেন না। এ অবস্থা চলতে পারে অনেকদিন। সে রাগ করতে পারে যে কারও ওপর, এমন কি যে মারা গেছে, তার ওপরও। এই সকল অনুভূতির নাম শোক।

অনেকেই মৃত্যু সম্পর্কে কথাই বলতে চান না। তারা বলেন, এটা দুঃখের কথা। এসব দুঃখের কথা ভাবার দরকার নেই। কিন্তু কখনও কখনও এ সম্পর্কে ভাবা দরকার। এই অবস্থা দেখে তুমি বুঝতে পারবে, যেদিন তোমারই দেখা হবে মৃত্যুর সঙ্গে, সেদিন! অন্যরা কী করবে তোমারও প্রিয় যদি কেউ মারা যায়, তা হরে নির্বাক হয়ে পড় বা রাগান্বিত থাকা, এ সবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে এক সময় মানুষ এই শোক কাটিয়ে ওঠে।

তুমি মরে গেলে কেউ শোকগ্রস্ত হবে না-এরকম অবস্থা ভাল নয়। পৃথিবীতে তোমাকে এমন কাজ করতে হবে, যাতে তোমার অভাব বোধ করে সবাই। অর্থাত মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু করতে হয় পৃথিবীতে। তবে পোষা প্রাণী বা মানুষ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তোমাকে একেবারে ছেড়ে যায় না। রেখে যায় তাদের স্মৃতি। এভাবেও তারা সারা জীবন তোমার সঙ্গে থাকে।
নিজেই নিজের যত্ন নাও
এই বইটার অন্য পৃষ্ঠাগুলো পড়ে তুমি বুঝতে পেরেছ, কী রকম তোমার শরীর। এটা একটা মেশিন। এই মেশিন ঠিক রাখতে দরকার যত্ন। তোমার শরীর সুস্থ রাখার একটি উপায় হয়-নিয়মিত ব্যায়াম করা, হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার কাঁটা, সাইকেল চালানো এবং লাফানো ভাল ব্যায়াম। এতে তোমার হৃদপিন্ড ও পেশী সবল থাকে। তুমি যদি উঠতি বয়স থেকেই ব্যায়াম করতে শুরু কর, তা হলে তোমার শরীর চলবে ঠিক মত। পেশী যদি ব্যবহার কর, তা হলে পেশী সুগঠিত হবে। সুগঠিত পেশী হাড়ের সঠিক গঠনে সাহায্য করে। ব্যায়ম ঠিকমত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে এবং শরীরে দ্রুত রক্ত চলাচলে সাহায্য করে।
তোমার শরীরের জন্য যথেষ্ট ঘুমও জরুরী। তুমি যখন ঘুমাও, তখন তোমার শরীরের অনেক পেশী বিশ্রাম নেয়। ঘুমের মধ্যে যদি চল্লিশ বার এপাশ ওপাশ কর, তা হলেও পেশীগুলো বিশ্রাম নিতে পারে। তবে শরীরের ঘুম বেশী দরকার মস্তিষ্কের জন্যই। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখছেন, পরপর তিন রাত না ঘুমালেও পেশী কাজ করে ঠিকই, কিন্তু ক্লান্ত মস্তিষ্ক তাদের এলামেলো করে ফেলে।

ঘুম প্রত্যেকের সমান দরকার নয়। তবে তোমার যতটুকু ঘুম প্রয়োজন, সেটা নিশ্চত করতে হবে। টিভি দেখতে দেখতে বা খেলতে খেলতে কখনও ভুলে যেও না যে, ঘুম তোমার মস্তিষ্কের জন্য কতটা প্রয়োজন।


----------